সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

ফলিংওয়াটার, এফ. এল. রাইট -আধুনিক স্থাপত্যের এক বিস্ময়

Fallingwater by Ar. Frank Lloyd Wright

0 873

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love

আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব এমন এক স্থাপত্যের, যার প্রতিটা সিঁড়ি, প্রতিটা দেওয়াল, প্রতিটা ঘর, জানলা-দরজা– প্রত্যেক মুহূর্তে শোনায় জঙ্গলের আর এক পাহাড়ি নদীর গল্প। যা প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দেয় এক অজানা রহস্যকে।

এমন বাড়ি আপনি ভু-ভারতের কোথাও খুঁজে পাবেন কিনা আমার জানা নেই। আমি বলছি– পেন্স্যিলভ্যানিয়ার “ফলিংওয়াটার”-এর কথা।

কি ভাবছেন? বাড়ির নাম আবার “ফলিংওয়াটার” হয় নাকি? হয় হয়। একটু অপেক্ষা করুন, কারনটা নিজেই বুঝতে পারবেন।

বাঙালির কাছে আইকন বলতেই যেমন চোখের সামনে ভেসে ওঠে রবীন্দ্রানাথ, সত্যজিৎ কিম্বা বিবেকানন্দ, সেরকমই আমাদের স্থপতিদের কাছে অন্যতম আইকন হলেন এফ. এল. রাইট বা ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট। রাইট সাহেব হলেন সেই সকল বিরল স্থপতিদের মধ্যে একজন যাকে কয়েকটা প্রজন্ম শুধু তার স্স্থাপত্যের জন্যই সারাজীবন মনে রাখবেন। ফলিংওয়াটার হল এফ এল রাইটের এক অনবদ্য স্থাপত্যকীর্তি যার জন্য গোটা পৃথিবী এফ এল রাইট’কে আজ এক ডাকে চেনে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম পেনসিলভানিয়ার, বেয়ার রান নদীর এক ঝরনার ওপর আংশিক ভাবে দাড়িয়ে আছে এই বাড়িটা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এর নাম কেন ফলিংওয়াটার। তবে এটুকুতেই অবাক হলে চলবে না।

সময়টা ১৯৩০’এর কাছাকাছি। লয়েড সাহেবের জীবনের সবথেকে সম্ভবত সবথেকে খারাপ সময়। স্থপতি হিসেবে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটা বাড়িই তিনি বানাতে পেরেছেন গত দশকে। এদিকে নতুন কাজও আসছে না। সঙ্গে পারিবারিক সমস্যা তো ছিলই। ঠিক এই সময় কাউফমান সাহেবের এই বাড়ি হয়ে ওঠে তার কর্মজীবনের কাম-ব্যাক।

এখানে বলে রাখা ভালো মার্কিন ধনকুবের কাউফমান সাহেব হলেন এই বাড়ির মালিক, যার জন্য এই বাড়িটাকে ‘কাউফমান রেসিডেন্স’ নামেও অনেকে চেনে।

কাউফমান সাহেবের ছেলে ছিলেন রাইটের ছাত্র, সেই সুত্রে কাউফমানের সাথে রাইটের পরিচয় হয় ১৯৩৪ সালে। তার কিছুদিনের মধ্যেই কাউফমান রাইট সাহেবকে বেয়ার রান নদীর তটে (কর্মচারীদের সামার ক্যাম্পের জন্যে) একটা বাড়ি বানানোর প্রস্তাব দেন। কাউফমানের এই অফার রাইট নিয়ে নিলেও, এক বছর এই বাড়ির জন্য কোনও কাজই তিনি করেননি। এদিকে কাজ অনেকদুর এগিয়েছে ভেবে একদিন আচমকাই কাউফমান চলে আসেন রাইটের কাছে বাড়ির প্ল্যান দেখার জন্য। আপনি শুনে অবাক হবেন যে, ঐ মুহূর্তে মাত্র দু ঘণ্টার মধ্যে রাইট এবং তার সঙ্গীরা পুরো বাড়ির ডিজাইন করে কাউফমানের কাছে পেশ করেন!

প্রথেমেই জানিয়েছি যে বাড়িটা আংশিক ভাবে একটা ঝরনার উপরে নির্মিত। মজার ব্যাপার হল বাড়ির মালিক কাউফমান সাহেব নিজেও জানতেন না যে তার বাড়িটা নির্মিত হবে ঝরনার উপর। তিনি চেয়েছিলেন যে বাড়ির মুখ থাকবে ঝরনার দিকে। আচমকাই প্ল্যানে ঝরনার উপর বাড়িটাকে ভাসমান অবস্থায় দেখে তিনি ভীষণ অবাক হয়েছিলেন।

১৯৩৫-১৯৩৯ সাল এই সময়ের মধ্যে পিটসবুরগ থেকে ৬৯কিমি দূরে অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ি নদীর পাড়ে মোট চারটি তলা এবং একটা গেস্ট-হাউস নিয়ে নির্মিত হয়েছিল বাড়িটা। এছাড়াও ফলিং ওয়াটারস আর জঙ্গলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য বানানো হয় একটা ব্রিজ। জনবসতি থেকে দূরে পাহাড়ি অরণ্যের মধ্যে দাড়িয়ে আছে বলে, বাইরে থেকে সহজেই বাড়িটাকে দেখতে পাওয়া যায় না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে ধিরে ধিরে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলে, তবেই সে হঠাৎ করে ঘন সবুজের মধ্যে থেকে অজানা আগন্তুকের মত দেখা দেয় ফলিংওয়াটার। আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়! চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা জঙ্গলের মাঝে একা দাড়িয়ে থাকে বাড়িটা। চারিদিকে শুধুই সবুজের হাতছানি। প্রকৃতি আর স্থপত্যের এমন অপরুপ মেলবন্ধনই একে ইট-পাথরের নিষ্প্রাণ স্থাপত্য থেকে এক অসামান্য শিল্পে উত্তীর্ণ করেছে!

যাইহোক, একটু এগিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে পারবোলা (pergola) টার নীচে দাঁড়ালেই দেখতে পাওয়া যায় ব্রিজটাকে। কানে ভেসে আসে ঝরনার জলের শব্দ। অন্দরমহলে প্রবেশ করলে সবার প্রথমেই পৌঁছানো যায় প্রথম তলার লিভিং রুমে। এই ঘরটার একপাশে আছে ফায়ারপ্লেস,যা ফলিংওয়াটারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। উলটো দিকে রয়েছে আরামদায়ক বসার জায়গা।

তবে সব থেকে অবাক করে দেওয়া ব্যাপার হল এই ঘরের মেঝে। কারন এই লিভিং রুমের মেঝের জন্য আলাদা করে কোনো পাথর বা টাইলস ব্যবহার করা হয়নি। প্রধানত বাড়িটি যে পাহাড়ের উপর ভাসমান তার পাথর কেটেই সেই সমতল অঞ্চল অংশকে ব্যবহার হয়া হয়েছে বসার ঘরে মেঝে হিসেবে। যা বাড়িটার অন্দরমহলকে বাইরের প্রকৃতির সাথে একাত্ম করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের ঘর ও বাহির সম্পর্কিত সেই বিখ্যাত উক্তিটাকে যেন প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় এই স্থাপত্য!

যাইহোক, এবার লিভিংরুম থেকে বেড়িয়ে বরং ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান যাক। আপনার চোখে পরবে ফলিংওয়াটার এর পিছনের জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের প্রধান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। একটু এগিয়ে গিয়ে নীচের দিকে তাকালেই দেখা যায় বেয়ার রান নদী। মনে হয় যেন ঠিক বাড়ির নিচে থেকেই উৎপন্ন হয়ে অবিরল ধারায় বয়ে চলেছে এই নদী।

বাড়ির দোতলায় আছে প্রধানত ব্যালকনি সহ শোবার ঘর। এখানে একটা অদ্ভুত বিষয় হল, শোবার ঘরের ছাদ সাধারনের তুলনায় একটু নীচু। জানলে অবাক হবেন যে, রাইট জেনে বুঝেই এই কাজটা করেছেন কারণ তিনি চেয়েছিলেন যে, সর্বক্ষণ অথিতিরা যাতে শোবার ঘরের বদ্ধ পরিবেশে না থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ব্যালকনিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করে।

বাড়ির তিন তলায় আছে লাইব্রেরী। আর বাড়ির থেকে আলাদা বাইরে পাহাড়ের একটু উঁচুতে রয়েছে গেস্ট-হাউস; একটা সিঁড়ি দিয়ে সংযোগ স্থাপন করা আছে উভয়ের মধ্যে।

অদ্ভুত ব্যাপারটা হল এই ফলিংওয়াটারের প্রতিটা রেলিং, দরজা জানালার ফ্রেম থেকে শুরু করে যত ফার্নিচার, সবই রাইট সাহেবের নিজের হাতে ডিজাইন করা। ঘর গুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আর্ট-ওয়ার্ক বা ভাস্কর্য। সত্যি বলতে কি, রাইট সাহেব ফলিংওয়াটার কে এক সাধারন বাড়ি হিসেবে না ভেবে, সন্তানস্নেহে গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিটা স্থপতি অবশ্য তাই করে।

বাড়ির বেশীরভাগ অংশই খোলামেলা। সর্বত্র কাঁচের জানালা ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে বাড়ির যে প্রান্তেই যাওয়া হোক না কেন, সবত্রই বাড়ির ভিতরের থেকে দেখা যায় বাইরের প্রকৃতিকে। এমনকি বাড়িটি তৈরির জন্য যে পাথর ব্যবহার হয় তাও স্থানীয় স্যান্ডস্টোন। এর কারন হল, রাইট সাহেব চেয়েছিলেন বাড়ির ভেতরের পরিবেশ যেন কখনই আবদ্ধ না হয়ে ওঠে, বাড়ির মধ্যে থেকেও যেন প্রতি মুহূর্তে বাইরের প্রকৃতির মনোরম পরিবেশকে অনুভব করা যায়। এছাড়াও স্থানীয় উপাদানের ব্যবহারে বাড়িটা শুধু পরিবেশ বান্ধবই হয়ে ওঠেনি, বরং ঐ নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে!

উপরি পাওনা হল সারাক্ষণ ভেসে আসতে থাকা ঝরনার জলের কল কল শব্দ, যা বাড়ির পরিবেশকে শুধু মনোরমই করে না, বরং করে তোলে রোমাঞ্চকর ও রহস্যময়। অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, বাড়ির প্রতিটা জায়গা থেকে ঝরনার শব্দ শোনা গেলেও, বাড়ির কোনো অংশ থেকেই শব্দের উৎসটিকে দেখতে পাওয়া যায় না। নদীর পার বেয়ে পাহাড়ের উপর দিয়ে খানিকটা নেমে গিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালে তবেই দেখতে পাওয়া যায় ফলিংওয়াটারের অদ্ভুত সৌন্দর্যকে। চারিদিকে সবুজের মাঝে বাড়ি সহ ঝরনাটাকে দেখলেই মনে হয় যেন, ঝরনাটা বাড়িরই এক অবিচ্ছেদ্দ অংশ।

এতক্ষণে হয়ত আপনার মনেও ইচ্ছা দানা বেঁধেছে যে, আপনারও যদি এমন এক খানা বাড়ি থাকত! প্রসঙ্গত এটা উল্লেখ করা ভালো যে, ফলিংওয়াটার বা কাউফমান রেসিডেনস কিন্তু কোনোদিনই পার্মানেন্ট রেসিডেন্স হয়ে উঠতে পারেনি। তার অন্যতম প্রধান কারন হল এই বাড়ির পরিবেশ এবং এর অবস্থান। প্রথমত বাড়িটা প্রধান জনবসতি থেকে বহু দূরে অবস্থিত, তাই প্রতিদিন পাহাড়ি অঞ্চল থেকে শহরে যাতায়াত করাটা ছিল এর প্রধান সমস্যা। এছাড়াও বাড়িটার চারপাশে শুধু জঙ্গল আর পাহাড়। যা বাড়ির পরিবেশকে এতটাই নির্জন করে তুলেছে যে, প্রথম কয়েকদিন হয়ত থাকতে আপনার খুবই ভাল লাগবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই নির্জন পরিবেশের একাকিত্ব আপনাকে গ্রাস করবে। অন্তত সাধারন শহুরে মানুষদের ক্ষেত্রে তো তাই হবে। অবশ্য, আপনি যদি আরন্যকের মত একখানা উপন্যাস ফাঁদার প্ল্যান কষেছেন, তবে এ বাড়ি মশাই আপনার জন্য আদর্শ জায়গা!

এই সমস্ত বিভিন্ন কারণেই কাউফমান সাহেব কোনোদিনই বাড়িটাকে স্থায়ীভাবে থাকার জায়গা হিসেবে গ্রহন করতে পারেননি। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫০ অবধি তিনি বাড়িটিকে উইকেন্ড হোম হিসেবেই ব্যবহার করেছিলেন।

১৯৫০ সালে কাউফমানের মৃত্যুর পর,তার ছেলে কাউফমান জুনিওর ওয়েস্টারন– পেন্সিল্ভানিয়া ট্রাস্টকে দান করেন বাড়িটি। সেই থেকে আজ অব্দি ফলিংওয়াটার মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৬৭ সাল থেকে আজ অব্দি প্রায় ৫০লক্ষ মানুষ শুধু এই বাড়িটাকে দেখতে এসেছেন। তাই আপনার ফলিংওয়াটারে থাকার ইচ্ছা পুরন না হলেও, কখনও মার্কিন মুলুক গেলে যেকোনো সময় একবার ঘুরে আসতে পারেন। যাইহোক, এই মুহূর্তে আপনার দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর জন্য নীচে কিছু ইউটিউব লিঙ্ক দিলাম। আশা করি এতে আপনার প্রথম দর্শনটা হয়ে যাবে।

লিখেছেন অভিরূপ দে

ফিচার ইমেজ সোর্স


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Leave A Reply

Your email address will not be published.