সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

সরস্বতীর উৎস সন্ধানে- প্রথম পর্ব

In Search of Lost River Saraswati- Episode 1

1 2,000

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love

ঝিমধরা শনিবারের দুপুর, ফেব্রুয়ারি মাস। শীতটা যাই যাই করেও ঠিক যাচ্ছেনা। জনাকয়েক বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম ফ্ল্যাটের ছাদে। কথায় কথায় জানা গেল রণিতের বাবা মা দিনকয়েকের জন্য বাইরে যাওয়ায় সে ইদানিং একাই বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। ব্যাস আর যায় কোথায়, তৎক্ষণাৎ প্ল্যান ফিক্স হয়ে গেল, আজ রাত্তিরে ছোটখাট এক খানা ফিস্ট হবে রণিতের বাড়িতে।

রণিতের বাড়ি খরিয়ালে, কোন্নগর স্টেশান থেকে সোজা যে রাস্তাটা চলে গেছে পার-ডানকুনির দিকে– সেই রাস্তা ধরেই প্রায় পনেরা বিশ মিনিট অটো ধরে যেতে হয়। নবগ্রাম, কানাইপুর, বাঁশাই পেরিয়ে অনেকটা পথ। ওদিকটায় যত যাওয়া যায় ততই বাড়িঘর কমে আসে; সারি সারি পুকুর, বাঁশবন আর বাড়ির ফাঁক দিয়ে দিয়ে পিছনের বিস্তীর্ণ চাষের জমি চোখে পরে। একটা গ্রাম্য ছোঁয়া আছে জায়গাগুলোয়।

রাত্রিবেলা খাওয়া দাওয়া সেরে বারান্দায় বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম সবাই। রনিতের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই একটা বেশ বড় বাঁশঝাড় আছে, সেখান থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে অনর্গল। শীতের রাতে অন্ধকার বারান্দায় চাদর মুড়ি দিয়ে জম্পেশ তর্ক বিতর্ক হচ্ছিল– ভূত থেকে ভারখয়ানস্ক, রাজনীতি থেকে রাহাজানি, কোন বিষয়ই বাদ নেই! কথা হচ্ছিল কোন্নগরের ইতিহাস নিয়ে, কথায় কথায় রণিত বলল–

জানিস ভাই, অনেক আগে এখান দিয়ে নদী বয়ে যেত একটা । এখান দিয়ে মানে, আমাদের বাড়িটা এখন যেখানে সেখান দিয়েই!

কি নদী?– প্রশ্ন করলাম।

সরস্বতী ভাই। আনেক আগে ছিল, আরে রাস্তার ধারে দেখলিনা এক লাইনে কতগুলো পরপর পুকুর? যখন আমাদের ডিপ টিউবওয়েলটা খোঁড়া হয়েছিল তখনই বুঝেছিলাম; এদিকটা আগে পুরোটাই নদীখাতের মধ্যে ছিল।

আমি রীতিমত অবিশ্বাসের সাথে প্রশ্ন করলাম, সরস্বতী? কি বলিস! সে তো বহুকাল আগেই লোপ পেয়েছে। ত্রিবেণীর ওখান থেকে ভাগ হয়েছিল সরস্বতী, ভাগীরথী আর যমুনা। এই সরস্বতী নদীর জন্যই তো একসময় সপ্তগ্রাম বন্দরের এত রমরমা ছিল। সম্ভবত আজ থেকে চারশো বছর আগে এই নদী নাব্যতা হারাতে শুরু করে, ফলে ধীরে ধীরে সপ্তগ্রাম বন্দর তার জৌলুশ হারায়। সে যাই হোক, পারডানকুনির এত কাছে সরস্বতীর নদীখাত– এটা আমার রীতিমত অবিশ্বাস্য লাগছিল!

কিন্তু রণিত নিঃসংশয়ে বলল। এখানেই নদীটা ছিল।

অর্কর বাড়িও এই অঞ্চলেই, ওরা বহুদিন ধরে এদিকে আছে। অর্ক বলল– না ভাই, আমি দাদুর মুখে শুনেছি। আগে এদিকে সত্যিই সরস্বতী নদী ছিল। রীতিমত বড় বড় নৌকা আর বজরা চলত। তবে দাদুও নিজের চোখে দেখেননি, তিনিও শুনেছিলেন তার দাদুর কাছে। এমনকি চাঁদ সওদাগর তো এই নদীপথ দিয়েই ভেসে গিয়েছিলেন! তুই খেয়াল করে দেখবি, নৈটি রোডের ধার দিয়ে প্রায় এক দেড় কিলোমিটার পথ জুড়ে সারি সারি পুকুর। নদীটা আনেক আগেই মরে গেছে, কিন্তু চিহ্ন স্বরুপ আজও পুকুরগুলো রয়ে গেছে!

বিদ্যুৎচমকের মত আমার মনে পরল, আরে ঠিক বলেছে তো! আর প্রাচীন নদী থাকলে তার পাশে পুরনো মন্দিরও থাকবে! এখানেও আছে! এদিকের সবথেকে প্রাচীন মন্দির হল বিশালাক্ষী তলা, সেও তো এরকমই এক পুকুরের ধারে! প্রাচীন মন্দির বলতে এখন অবশ্য আর কিছু বোঝার উপার নেই, পুরনো টেরাকোটা মন্দিরের উপর আধুনিক সাদা টাইলস বসিয়ে সব সাফ করে দিয়েছে। তবুও বাঁ পাশের মন্দিরটাকে আঁকড়ে ধরে এক বহু প্রাচীন বট গাছ উঠে গেছে; সেটা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায় জায়গাটার প্রাচীনত্ব! তাহলে কি সেই চারশো বছর আগের হারানো নদীর স্মৃতি এভাবেই বেঁচে আছে এ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতিতে? জনশ্রুতিতে?

পরবর্তী কয়েকদিন কাজের চাপে এই বিষয়টা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহান্তে আবার ছুটি পেয়ে গুগল ম্যাপটা খুলে বসলাম! কি আশ্চর্য! পুকুর গুলোকে একটা লাইন ধরে যোগ করলেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নদীর গতিপথটা! কিন্তু সমস্যাটা হল উত্তরপূর্বে প্রায় তিন চার কিলোমিটার পর নবগ্রাম বারুজীবী কলোনির কাছে গিয়ে নদীপথটা হারিয়ে গেছে! আবার পশ্চিমদিকে পারডানকুনির কাছে গিয়ে নদীর ট্র্যাকটা মিশে যাচ্ছে ঘন বসতির মধ্যে! গুগল ম্যাপটা দেখেই গোটা বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেল, বাঁশাই বা খরিয়ালের মত জায়গায় এখনো জনবসতি কম, গাছপালা বেশী। তাই এত বছর পরও নদীর অবশেষটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। কিন্তু যখনই ট্র্যাকটা কোন্নগর বা ডানকুনি এলাকায় ঢুকেছে, ঘন বসতির মধ্যে আর চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা! হবে নাই বা কেন, যদি ধরেও নি যে আজ থেকে আড়াইশো বছর আগেও নদীটার মৃত্যু হয়েছে তবুও সে এক দীর্ঘ সময়! নদী থেকে হয়েছে পুকুর, শেষে মানুষ সেই পুকুর বুজিয়ে বসতি করেছে- খুব স্বাভাবিক পরিনতি!

যাইহোক, প্রথমেই রেনেল আর ভ্যান ডে ব্রুকের ম্যাপ খুলে বসলাম! স্বভাবতই কিছু পেলামনা! কারণটা হল, এই নদীটা সম্ভবত মূল সরস্বতীর অংশ নয়! কারন মূল সরস্বতী নদীর মৃতপ্রায় খাতটা আজও দেখা যায় গোবরার কাছে। সেই মূল নদীখাতথেকে এই নদীর দূরত্ব হবে অন্তত তিন চার কিলোমিটার! তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল, মূল সরস্বতী বা ভাগীরথী হুগলীর গতিপথ ত্রিবেণী থেকে আলাদা হবার পরও দুই নদী মোটামুটি ভাবে সমান্তরালে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে গিয়ে সরস্বতী আবার সাঁকরাইলের কাছে ভাগীরথীর সাথে মিশেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে নদীটার অবশেষ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা বয়ে গেছে পূর্ব পশ্চিমে, অর্থাৎ মূল নদীর সাথে আড়াআড়ি ভাবে! সম্ভবত এই নদীটা ছিল মূল সরস্বতীর কোন উপনদী! হয়তো মূল সরস্বতীর সাথে যুক্ত থাকার কারণেই স্থানীয় মানুষের ইতিহাসে আজও সরস্বতীর নামটাই ঘুরে ফিরে আসে!

আমি স্থাপত্যের ছাত্র, স্বভাবতই এর থেকে বেশী অনুমান করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে! ভূগোলের ছাত্ররা হয়তো টপোগ্রাফি, এলিভেশান, স্লোপ ইত্যাদির বিচার করে নিশ্চিত হয়ে মতামত দিতে পারবে!

কিন্তু এর পরও একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল! কিংবদন্তি চাঁদ সওদাগর যদি সত্যিই সপ্তডিঙ্গা ভাসিয়ে বানিজ্য যাত্রায় বেরিয়েছিলেন তবে তিনি কোন নদীপথ বেয়ে গিয়েছিলেন? ভাগীরথী না সরস্বতী? যতদূর জানি মঙ্গলকাব্যে কোন্নগরের উল্লেখ আছে, এর অর্থ হল তার গতিপথ ছিল ভাগীরথীর পথ বেয়েই! কিন্তু সুদূর অতীতে যদি সত্যিই সরস্বতী নদীর মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হত গঙ্গার মূল ধারা, তবে তো হিসেব মিলছেনা! পরে বুঝলাম যে ব্যাপারটা এত সরল নয়! মঙ্গলকাব্য বহুবার বহু লেখক লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে! অষ্টাদশ শতকের পর লেখা কাব্যের বর্ণনায় কোন্নগরের উল্লেখ আছে, অর্থাৎ তখন সরস্বতী লুপ্তপ্রায়! স্বভাবতই লেখক তার কল্পনায় ভাগীরথীর গতিপথেরই বর্ণনা দিয়েছেন! আবার প্রাচীন কাব্য অনুযায়ী চাঁদ সওদাগরের যাত্রপথ ছিল সরস্বতীর পথ বেয়েই! তবে এই প্রসঙ্গে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার আগে আরো অনেক তথ্য ও গবেষণার প্রয়োজন।

ষোড়শ শতকে ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিক ধরে সপ্তগ্রাম হয়ে বয়ে চলত সরস্বতী নদী। সপ্তম শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে সরস্বতীর উৎপত্তিস্থলে পলি জমতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে ষোড়শ শতক নাগাদ প্রায় শুকিয়ে যায়। সেই সরস্বতীর অবশেষ এখন নিতান্তই খাল, ক্ষীণজলের ধারা, দূষিত জলাশয় আকারে ত্রিবেনী থেকে বেরিয়ে শঙ্খনগর, সপ্তগ্রাম পার করে হারিয়ে গেছে প্রবাহপথ। একটি মজে যাওয়া শাখা আন্দুল কলেজের পাশ হয়ে এখনও বইছে। তারপর বুজে গেছে অথবা আটকে গেছে জনবসতির চাপে, কচুরিপানায় কিংবা মাছের ভেরিতে, নদী গিলে ফেলা ইট ভাটায়। অতীতে সরস্বতী বাংলার নদী বন্দর নগরের উন্নয়ন ও পতন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রাথমিকভাবে, প্রধান সমুদ্র বন্দর নগর তাম্রলিপ্ত ছিল, যার পতনের পর সপ্তগ্রাম আসে, এবং পরিশেষে কলকাতা। চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যপোতের সাগরযাত্রার পথটি ছিল– সপ্তগ্রাম থেকে উজানে ত্রিবেণী হয়ে সাগর। বিশ্বাস করা হয় সরস্বতী অধুনা রূপনারায়নের খাত বরাবর বয়ে মোহনায় পড়ত তাম্রলিপ্ত (অধুনা তমলুক) হয়ে। তখন সরস্বতীর উপনদী ছিল রূপনারায়ন, দামোদর সহ অনেক ছোট নদনদী। তাম্রলিপ্ত আগে ছিল এক সমৃদ্ধ সমুদ্রবন্দর । (তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া)

কল্পনার ফানুস উড়ে যায় বহুদূরে! মনে হয়, সাতশো বছর আগে হয়তো ইবন বতুতার জাহাজ বয়ে গিয়েছিল এই নদীপথ বেয়েই, হয়তো বক্তিয়ার খিলজির রণতরী নোঙর ফেলেছিল এই উপনদীর তীরেই! হয়তো গৌড়ের পতনের পর লক্ষ্মণসেন পূর্ববাংলায় পালিয়ে যাবার আগে এই পথেই কোথাও আত্মগোপন করেছিলেন! কত ইতিহাসের নীরব দর্শক এই ধারাপ্রবাহ!

যাইহোক, সরস্বতী নদী বলতেই অনেকের প্রথমেই মাথায় আসে ঋক বেদে উল্লিখিত প্রাচীন নদীর কথা। বর্তমান সরকার তো শুনছি উঠেপড়ে লেগেছে সেই প্রাচীন নদীর অস্তিত্ব প্রমান করতে । বছর দুই আগে খবরে দেখেছিলাম সম্ভবত হরিয়ানার এক গ্রামের মাটির তলায় খুঁড়ে সেই প্রাচীন কিংবদন্তীর প্রমান পাওয়া গেছে । মাটি খুঁড়তেই নাকি হারানো নদীর জল উঠে আসছে, মানুষের কি বিপুল আগ্রহ!

অথচ এই বাংলাতেও যে সেই একই নামে এক সমৃদ্ধশালী প্রাচীন নদী ছিল– তার কথা অনেকেই জানেন না! কালের নিয়মেই সরস্বতী আজ ক্ষীণ হতে হতে মিশে গেছে ধানক্ষেতের ক্যানেলের মধ্যে, ঠিক যেমন সেদিনের আদি গঙ্গা আজকের টালি নালা– মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে কচুরিপানা আর নাগরিক আবর্জনার ভারে! পরিবেশবিদরা সরব হন, সরকারী কিছু ফাইল চালাচালি হয়। গালভরা কিছু রিভার রিভাইভিং প্রজেক্ট নেওয়া হয়, শেষ অব্দি কয়েক কোটি টাকার অপচয়! কাজের কাজ কিছুই হয়না! তবে সমস্ত নিরাশার মাঝেও কিছু কিছু আশার আলো রয়ে যায়, যখন খবরে উঠে আসে যে আজও আদি গঙ্গার একটা ক্ষীণ ধারা বয়ে চলেছে অন্তঃসলিলা হয়ে! তখন ভালো লাগে। আশা জাগে। আমরা বাঁচাতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতি নিজেই খুঁজে নিয়েছে বেঁচে থাকার পথ ।

সরস্বতীর উৎস সন্ধানে- দ্বিতীয় পর্ব

সরস্বতী নদী সম্বন্ধে বিস্তারে পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

লিখেছেন অরুনাভ সান্যাল, কো- ফাউন্ডার ও এডিটর, স্থাপত্য

ফিচার ইমেজ ও অন্যান্য উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া।


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

  1. ভাস্কর চোংদার says

    বিষয়ঃসরস্বতী নদী
    উদ্ভব ও বিবর্তন অত্যন্ত সহজভাবে উপস্হাপিত।প্রয়োজনীয় টেকস্ট্,রেফারেন্স,ম্যাপস ও ডায়াগ্রাম আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলে আরোও বুঝতে সুবিধা হতো।আশাকরি আগামীদিনে ভৌগোলিক অবস্হান সংশ্লিষ্ট বিষয়টি একই সঙ্গে দেখতে পাবো।

Leave A Reply

Your email address will not be published.