সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

সরস্বতীর উৎস সন্ধানে- দ্বিতীয় পর্ব

In Search of Lost River Saraswati- Episode 2

0 805

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love

সরস্বতীর উৎস সন্ধানে- প্রথম পর্ব

গতবছর গুগল ম্যাপে পুকুর ধরে ধরে ট্রেস করে সরস্বতীর যে হারানো শাখানদীকে পেয়েছিলাম তার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সেদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল যে সময় পেলে একদিন সরস্বতীর মূল ধারাটাকে দেখে আসব। শেষ অব্দি আজকে দুপুরে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পরলাম। পার-ডানকুনির মোড় থেকে চণ্ডীতলা অব্দি আটো সার্ভিস আছে। আটো’টা গোবড়া স্টেশনের আগে একটা ছোট্ট খাল পের হবার পর কিছুটা গিয়ে চণ্ডীতলার কাছে আবার দ্বিতীয় একখানা খাল পার হয়ে থামল।

কোনটা যে সরস্বতীর মূল ধারাপ্রবাহ সেটা নিয়ে আমি প্রথমে একটু সন্দিহান ছিলাম। পরে গুগল ম্যাপ খুলতেই সন্দেহের নিরসন হল! গোবড়া স্টেশনের আগে যে খালটা পেরোলাম সেটা হল আদতে বালি খালের একটা প্রসারিত অংশ। প্রথম খালটা উত্তরে বহুদূর গিয়ে বৈদ্যবাটি এবং চন্দননগরের মাঝে আবার মিলিত হয়েছে ভাগিরথীর সাথে । অপরপক্ষে, দ্বিতীয় খালটাই হল সরস্বতীর মূল ধারা, যেটা বয়ে গেছে চণ্ডীতলার কাছে স্টেট হাইওয়ে ১৫’র একদম গা বেয়ে।

তবে এই প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে ঘণ্টা খানেক গুগল ম্যাপ ঘেঁটেই বুঝেছিলাম যে নদীর হারানো গতিপথটা নির্ধারণ করাটা কিন্ত মোটেও সোজা কাজ না। কারন প্রাচীন সরস্বতীর মূল ধারা ছাড়াও, এই নদী থেকে নির্গত হয়েছিল অসংখ্য শাখানদী। ত্রিবেণী থেকে মূল শাখাটা দক্ষিণ পশ্চিমে বয়ে গিয়েছে সিঙ্গুর অব্দি। সেখান থেকে একটা ধারা আবার দক্ষিণে বয়ে গিয়ে সাঁকরাইলের কাছে ভাগীরথী-হুগলীর সাথে মিলিত হয়েছে। কিন্ত আশ্চর্যের ব্যাপারটা হল , নসিবপুরের কাছাকাছি আবার একটা ক্যানেল (আদতে উপনদী), উত্তর পূর্ব থেকে বয়ে এসে যুক্ত হয়েছে সরস্বতীর সাথে। এই ক্যানেলটাকে গুগল ম্যাপে ট্রেস করলে দেখা যায়, এর উৎপত্তি হয়েছে দামোদরের বুক থেকে। মূল নদী ও তার অসংখ্য উপনদীর মৃতদেহ আদতে ক্যানেল, নালা এবং পুকুর হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা এলাকাটা জুড়ে। সেখান থেকে তার মূল গতিপথটাকে নির্ধারণ করা রীতিমত পরিশ্রমসাধ্য কাজ।

যাইহোক, অটো’টা স্টেট হাইওয়ে ১৫’র কাছে গিয়ে থামল। আজকের সরস্বতীকে দেখে রীতিমত হতাশ হলাম। অবস্থা এতটাই খারাপ যে আলাদা করে বিশেষ কিছুই বলার নেই। আশে পাশের বাড়ি ও দোকানের যত আবর্জনা আর বিষের মত কালো জল এসে পড়ছে খালের উপর। আশে পাশের দোকানদার’রা জানাল যে এটা যে সরস্বতী নদী তা এই এলাকার অনেকেই জানেন। বছর দশ পনেরো আগে, বাম আমলে একবার সরকারি আমলারা এসেছিলেন এখানে। রিভার রিভাইভিং প্রজেক্টের আওতায় বেশ কিছু টাকা বরাদ্দও হয়েছিল। কচুরি-পানা তোলা হয়। কিন্ত নদীর অবস্থা এতটাই খারাপ যে তার এক দুবছরের মধ্যেই আবার যে কে সেই!

একজন ধুতি পরা বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসেছিলেন চায়ের দোকানে। আমাকে এই নদী নিয়ে খোঁজ খবর করতে দেখে তিনি সাগ্রহে এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোক বললেন যে তার ঠাকুরদার আমলে, যখন এই অঞ্চলে তেমন জনবসতি হয়নি, তখন এই মজে যাওয়া খাল দিয়ে ছিপ নৌকায় গঙ্গার জলদস্যুরা যাতায়াত করত রাতে। তারও আগে নাকি এই দোকান সহ গোটা অঞ্চলটাই ছিল সেই প্রকাণ্ড নদীখাতের ভিতর! তার বাল্যকালে তিনি গল্প শুনেছেন যে, এই অঞ্চলের কৃষকরা নদীর ধারের জমিতে চাষ করতে গিয়ে মাটিতে প্রোথিত জাহাজের প্রকাণ্ড মাস্তুল দেখেছে কিম্বা জমি কর্ষণ করতে গিয়ে উঠে এসেছে বহু প্রাচীন সূর্যমূর্তির ভাঙ্গা অংশ। এসব অবশ্য সবই শোনা কথা!

ফেরার সময় ভারাক্রান্ত মনে গুগলম্যাপ ঘাঁটছিলাম। সিঙ্গুর ও পুরুশোত্তমপুরের মাঝে এক প্রকাণ্ড অশ্বখুরাকৃতি নদীখাত চোখে পরল! এখন অবশ্য নদীটা আর অবশিষ্ট নেই, কিন্ত প্রকাণ্ড পুকুরগুলোকে মার্ক করলেই বিশাল নদীখাতটা বোঝা যায়! পুকুরগুলো আকারে বিশাল, অন্তত একশো–দেড়শো মিটার চওড়া (নীচের ছবি দেখুন)। বোঝা যায় যে, সরস্বতীর যৌবনকালে মূল নদীখাতটা কি প্রকাণ্ড ছিল। অর্থাৎ একসময় এই সরস্বতী নদী প্রবাহিত হত আজকের সিঙ্গুরের গা বেয়ে। শুধু তাই নয়, এই সিঙ্গুর অঞ্চলটা ছিল মূলত তিনটে নদীর মিলনস্থল কারন উত্তরপূর্বের দামোদর থেকেও একটা নদীটা প্রবাহিত হয়ে সরস্বতীর সাথে মিলিত হয়েছিল এই সিঙ্গুর অঞ্চলে। হাওড়া থেকে সিঙ্গুরের যাবার পথে, দিয়াড়া বলে একটা স্টেশন আসে। এই দিয়াড়া শব্দটার অর্থ হল ‘চর বা চড়া‘। সম্ভবত মূল নদীর পরিত্যক্ত নদীখাত থেকেই এই জায়গাটার নামকরন হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে একটা খুব আশ্চর্য তথ্য দিই আপনাদের। সম্রাট বিজয়সিংহ’র লঙ্কা বিজয়ের কাহিনী তো আমরা সবাই শুনেছি। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন গ্রন্থ মহাবংশেও বিজয় সিংহের আদি ভূমি হিসেবে উল্লেখ আছে লালা’র। অনেকের মতে এই লালা হল দক্ষিণ বাংলার লাঢ়া বা রাঢ় অঞ্চল! ঐতিহাসিক হেম চন্দ্র রায়চৌধুরী বলেছিলেন, বিজয় সিংহের পিতা সিংহবাহুর রাজধানী হিসেবে যে সিংহপুরের উল্লেখ আছে তা হল আদতে আমাদের দক্ষিণবঙ্গের সিঙ্গুর। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থানে এই সিংহপুরকে চিহ্নিত করেছেন। গুজরাটি’রা বিজয় সিংহকে তাদের পূর্বপুরুষ বলে দাবী করে থাকেন।

তবে সবথেকে আশ্চর্য বিষয়টা কি জানেন?

ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, জেনেটিক স্টাডি তো কখনো মিথ্যা বলেনা! এখন অব্দি শ্রীলঙ্কানদের উপর যত জেনেটিক স্টাডি করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে তাদের ডিএনের শতকরা ৭০-৮২% মিল রয়েছে বাঙালিদের সাথে! সেখানে দক্ষিণ ভারতীর ‘তামিল’ কিম্বা গুজরাটিদের সাথে জেনেটিক মিল রয়েছে মাত্র ১২% থেকে ১৬%! বিশ্বাস না হলে আপনারা, ‘Genetic studies on Sinhalese’ লিখে গুগল সার্চ করে দেখুন।

আসলে কি জানেন, মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসকে যদি খুঁজে বার করতে হয় , যদি হারিয়ে যাওয়া নগর-সভ্যতার পদচিহ্ন গুলোকে খুঁজে বের করতে হয় তাহলে সবার প্রথমে খুঁজতে হবে নদী ও জল’ধারাকে। কারন সেই যুগে এই নদীই ছিল মানুষের বেঁচে থাকার প্রানভোমরা। কত বন্দর, কত সমৃদ্ধ গ্রাম গড়ে উঠেছিল এই নদীকে কেন্দ্র করে । এই সরস্বতী নদীর মজে যাওয়া খাত দিয়েই তো একদিন সপ্তগ্রামে এসেছিলেন ইবন বতুতা, হয়ত এই নদীখাত দিয়েই পরাজিত লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে, এই নদীপথ দিয়েই দুর্ধর্ষ পর্তুগীজ জলদস্যুরা প্রবেশ করেছিল হুগলীতে, কত সাম্পান, কত সপ্তডিঙ্গা, কত রণতরী ভেসে গিয়েছে এই নদীর বুক দিয়ে।

ইতিহাস বিষয়টা আসলে কোন স্বতন্ত্র বিষয় নয়। কারণ নতুন কিছু যদি খুঁজে বার করতে হয় তাহলে দেখা যায়, এক জায়গায় গিয়ে ইতিহাস, ভূগোল, স্থাপত্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান– সব মিলে মিশে গেছে! আর এই মিলনটা হলে তখনই সত্যানুসন্ধান পূর্ণতা পায়।

আজকের মত এইটুকুই। সবাই ভালো থাকবেন।

সরস্বতী নদী সম্বন্ধে বিস্তারে পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

লিখেছেন অরুনাভ সান্যাল, কো- ফাউন্ডার ও এডিটর, স্থাপত্য

ফিচার ইমেজ ও অন্যান্য উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া।


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Leave A Reply

Your email address will not be published.