সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

লড়ছে প্রেসিডেন্সি, সময়ের কাছে উত্তর খুঁজছে লাল বাড়িটা

Presidency University fights back with the legitimate demand of getting back the Hindu Hostel

0 1,076

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love

সোশাল মিডিয়া বা খবরের কাগজে যদি নিয়মিত চোখ রেখে থাকেন, তাহলে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির হিন্দু হস্টেলের নামটা এতদিনে আপনার ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছে। তবে বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকুক না ঢাকুক, খবরের বাড়বাড়ন্তে আমাদের জানার আগ্রহ অনেক দিনই স্বর্গগত। তাই জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলবেন, ‘ওই, কি যেন একটা আন্দোলন চলছে!’ এই কী বা কেন র খোঁজেই প্রেসিডেন্সির চত্বরে ‘স্থাপত্য’এর ভার্চুয়াল অনুপ্রবেশ।

presidency university, hindu hostel, hindu hostel protest, kolkata, presidency kolkata, protest, dharna, hunger strike, anuradha lohia, sthapatya, sthapatya.co

এগোনোর আগে একবার ফিরে যাব ইতিহাসের পাতায়। আঠারোশ ছিয়াশি সাল- তৎকালীন হিন্দু কলেজের ছেলেদের জন্য বর্তমান প্যারি চরণ সরকার স্ট্রিটে গড়ে তোলা হয় ইডেন হিন্দু হস্টেল, অ্যাশলে ইডেন সাহেবের ফান্ডের সাহায্যে। ছ টি ওয়ার্ড মিলিয়ে এর ব্যাপ্তি ছাব্বিশ হাজার স্কোয়ার ফিট। খড়খড়ি দেওয়া জানলা, নীচের তলার দেওয়ালে খাঁজকাটা বা ‘রাস্টিকেশন’, লাল রঙা এই ভবনের আনাচে কানাচে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। তফাত শুধু একটাই, কলকাতার অসংখ্য ঐতিহাসিক ইমারতের মতো সময়ের স্রোতে ভেসে যায়নি হিন্দু হস্টেল। আজও প্রায় আড়াইশো জন ছাত্রের তপোবন একশো বত্রিশ বছরের এই বাড়িটি – অন্ততঃ 2015 পর্যন্ত তাই ছিল।

খড়ের গাদায় ছুঁচ খুজলে পেতে পারেন তবে কলকাতায় দাঁড়িয়ে পুরনো বাড়ি সংরক্ষণের কোনো প্রয়াস চোখে পড়া প্রায় অসম্ভব। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে 2015 সালের জুলাই মাসে হস্টেলের আবাসিকদের সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, হস্টেল সংরক্ষণের স্বার্থে, স্বাভাবিকভাবেই ছাত্ররা তাতে আপত্তি জানাননি। যদিও কারণ যে ছিল না, তা নয়। এগারো মাস খুব একটা কম সময় নয়। তা ছাড়া, নতুন হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয় সুদূর রাজারহাটে, যেখান থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করা দুর্বিষহ।

presidency university, hindu hostel, hindu hostel protest, kolkata, presidency kolkata, protest, dharna, hunger strike, anuradha lohia, sthapatya, sthapatya.co

নোটিশ ইস্যু করা হয় এমন একটি সময়ে যখন সেমিস্টার ব্রেক চলায় অধিকাংশ আবাসিক ই ছুটি তে ছিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিছু ডকুমেন্ট চেয়ে পাঠানো হয় – কাজের প্রত্যাশিত সময়সীমার একটা লিখিত প্রমাণপত্র, সল্টলেকে সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করায় কর্তৃপক্ষের অক্ষমতার স্বীকারোক্তি এবং অতঃপর নিউ টাউনের তরুলিয়ায় থাকার আয়োজন এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশনের সার্কুলার এর একটি কপি । কোনো উত্তর যে পাওয়া যায়নি তা বলাই বাহুল্য।

এর পরের দৃশ্য 2016 র আগস্ট- এর। মাসের সংখ্যা এগারো ছাড়িয়ে তেরোতে পড়লেও কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো হেলদোল নেই দেখে আন্দোলনের পথে হাঁটেন ছাত্ররা। 6 ই আগস্ট 2016 থেকে অনির্দিষ্টকালীন অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা গোড়াতেই পরিষ্কার করে দেন যে হস্টেল ফেরত পাওয়া অথবা কাজের বর্তমান গতিপ্রকৃতি জানা ছাড়া তাঁদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তা সত্ত্বেও রেজিস্ট্রার প্রথম বর্ষের ভর্তির প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া এবং ‘গুন্ডামি’র অভিযোগ তোলেন ছাত্রদের বিরুদ্ধে। যদিও কলেজ স্ট্রিটে ধর্ণায় বসা শিক্ষার্থীরা নিউ টাউনের আবাসনে কীভাবে সমস্যার সৃষ্টি করছেন, তার কোনো যুক্তি পাওয়া যায়নি।

 ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হস্টেল মেরামত এবং সংরক্ষণের একটি বিস্তারিত লিখিত বিবরণ তুলে দেওয়া হয় ছাত্রদের হাতে। শব্দের আড়ম্বরে সেখানে অধিকাংশ উত্তরই ধাঁধাল । আন্দোলনকারীদের মতে কোনো সমাধান নয়, বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্যেই এই পদক্ষেপ।  শিক্ষার্থীদের প্রতি কলেজের দায়িত্ববোধ এবং মেরামতির কাজে তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কর্তৃপক্ষের সাফাই, হঠাৎ করে কাজের খরচ বেড়ে যাওয়াতেই এই বিলম্ব।

এদিকে ছাত্রদের ভোগান্তি বাড়তে থাকে। নতুন হস্টেলে পানীয় জলের সমস্যা, তাই কিনে খেতে হচ্ছে মিনারেল ওয়াটার; মশার প্রকোপ তো রয়েছেই। এছাড়াও নিউ টাউন থেকে যাতায়াত করতে যে সময় লাগে তাতে অনেকেই প্রথম ক্লাসটি ধরতে পারছেন না – ফলে 75% উপস্থিতি বজায় রাখা কঠিন হচ্ছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি কোথাও বাসস্থান খুঁজতে গেলে পকেটের মায়া ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ, যাকে বলে শাঁখের করাত।

তৃতীয় পর্বের সূচনা 2018 র জানুয়ারী মাসে। তিতিবিরক্ত শিক্ষার্থীরা এক মাসের মধ্যে হস্টেল ফিরেয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন। বিশে জানুয়ারী প্রেসিডেন্সি থেকে হিন্দু হস্টেল পর্যন্ত একটি মিছিলের আয়োজন করা হয় হস্টেল সংরক্ষণের কাজে গাফিলতির প্রতিবাদে। একটি ওয়েলফেয়ার কমিটি গঠন করার আবেদন জানানো হয় যার সদস্যমণ্ডলীর মধ্যে পাঁচজন আবাসিক থাকবেন এবং প্রতি পনেরো দিন অন্তর এই কমিটি কাজের গতি প্রকৃতি নিয়ে আলোচনায় বসবে। 29 শে জানুয়ারী উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া একটি নোটিশ ইস্যু করেন। তাতে প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটির একটি মিটিং ডাকা হয় আর্কিটেক্ট এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে। 15 ই জুলাই হস্টেলের কাজ শেষ হবে এবং পয়লা আগস্ট থেকে ছাত্ররা সেখানে থাকতে পারবেন বলেও উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়। পড়ুয়ারা এই মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সাত দিনের মধ্যে মিটিং আয়োজন করার দাবি রাখেন। কর্তৃপক্ষ কোন কথাই কানে তোলেনি।

শেষপর্যন্ত 31 শে জুলাই অপর একটি বিজ্ঞপ্তিতে কমিটি গঠনের দাবি মেনে নেওয়া হয়। ডেভেলপমেন্ট অফিসার, ডিন অব স্টুডেন্টস, ভূগোলের বিভাগীয় প্রধান, হস্টেল সুপার, ইউনিভার্সিটি ইঞ্জিনিয়ার এবং পি ডব্লিউ ডি ইঞ্জিনিয়ার পড়ুয়াদের সাথে মিটিংয়ে বলেন যে কাজ শেষ হতে আরও পাঁচ-ছ মাস লাগবে। কর্তৃপক্ষের এই বারবার সুর বদলে আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে 3 রা আগস্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিক্ষোভ শুরু করেন পড়ুয়ারা। গত প্রায় 40-45 দিন ধরে ক্যাম্পাসেই রয়েছেন ছাত্রদের একাংশ। মশার দাপটে প্রায় আট জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত, অসুস্থ আরও অনেকে – আবাসিক এবং ভে স্কলার উভয়ই। কলেজ ক্যাম্পাসের অবস্থাওযে শোচনীয় তা বলাই বাহুল্য। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন সমর্থন করছেন অনেক প্রাক্তনীরাও। কেউ প্রত্যক্ষ কেউ বা পরোক্ষ ভাবে।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ঘিরে – 11 ই আগস্ট যে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল রাজ্যপালের। 10 তারিখ ক্যাম্পাস অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাতারাতি অনুষ্ঠানটিকে নন্দনে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পড়ুয়াদের বক্তব্য যে 10 তারিখ দুপুর তিনটে নাগাদ ফোন করা হয় উপাচার্যকে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ তাঁকে ক্যাম্পাসে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়, এমনকি সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজনে কোনো রকম বাধা দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। উপাচার্য সাফ জানিয়ে দেন যে তিনি ‘নট ইন্টারেস্টেড’।

11 তারিখের অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র ডি. লিট. দেওয়া হয় কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। ডিগ্রি পাননি কোন ছাত্রছাত্রীই। সূত্রের খবর যে ওই দিনই ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো হুমকি দিয়ে যান অনুরাধা দেবী; আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে কেউই ডিগ্রি পাবে না, ঘোষণা করেন উপাচার্য। পড়ুয়াদের মতামত, ডিগ্রি পাওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার প্রয়াস করা হচ্ছে।

নদীর স্রোত যাই হোক, সমুদ্রে তো তাকে পৌঁছতেই হবে, তাহলে এই অকারণ দেরি করার যৌক্তিকতা কোথায়? আর সমস্যা যদি থেকেই থাকে তাহলে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তা পরিষ্কারভাবে স্বীকার করা হচ্ছে না কেন? জটিলতা যেখানেই থাকুক না কেন, তার জেরে আপাতত অথৈ জলে হিন্দু হস্টেল এবং সেখানকার আবাসিকরা।

হিন্দু হস্টেল শুধু কলকাতার বুকে নয়, হৃদয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দূরদূরান্ত থেকে সেইসব ছাত্ররা যাঁরা কলকাতায় এসে পড়ার স্বপ্নটুকু দেখারও সামর্থ রাখেন না, হিন্দু হস্টেল তাঁদের আপন করে নিয়েছে। ভেতরের মানুষ গুলো চিরকালই বড্ড আবেগপ্রবণ। তাই বোধহয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেও মুখে রা কাড়েন নি কোনোদিন। ক্রিকেট, ফুটবল আর এগিয়ে যাওয়ার জেদ নিয়ে মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন দিনের পর দিন। কত দিন বদলে যাওয়ার আঁতুড়ঘর এই বাড়ি। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের জন্মও তো এখানেই। স্মৃতির জানলা খুলে দিলেই দেখবেন ইতিহাসের পথে তার ঝরে যাওয়া টুকরো গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে এর উল্লেখ রয়েছে, আর হিসেব রয়েছে অসংখ্য ছাত্রের যাত্রাপথে। লাল মোড়কে কে যেন স্বপ্নের একটা হালখাতা রেখে গেছে শহরে; প্রতি বছর তাতে নতুন নামের ভীড়।

এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে এই প্রতিবেদন ‘স্থাপত্য’ এ কেন? ইঁট-কাঠ-পাথর দিয়ে যে প্রতিমা তৈরি হয়, তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন সেখানকার আবাসিকরা। দিনের পর দিন অবহেলায় পড়ে থাকা ফাঁকা ইমারত সময়ের ভাঁজে শুধু তার কাঠামো নিয়ে আটকে থাকে, ভবিষ্যত তার খোঁজ রাখে না।

লিখেছেন অরুণিমা ঘোষ

ফিচার ইমেজ- ফেসবুক। বাকি ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে সংগৃহীত।


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Leave A Reply

Your email address will not be published.