সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

স্ফটিক বাড়ি- এশরার লাতিফ

Sphatik Bari (short story)- Dr. Eshrar Latif, Lecturer- Cardiff University & Programme Leader- MSc Sustainable Mega-Buildings

0 494

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love

ভদ্রমহিলা দরজায় দুবার টোকা দিলেন। কিন্তু অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। স্থির ভাবে ঘরে ঢুকে উলটো দিকের চেয়ার টেনে বসলেন।

সবে একটা স্যান্ডউইচ মুখে দিয়েছি। টেবিলের উপর ট্যাপা খাওয়া এলুমিনিয়ামের লাঞ্চ বক্স। লাঞ্চ বক্সের ভেতরে তার দ্বিগুণ ট্যাপা খাওয়া সিদ্ধ ডিম।

এ সময়ই আসতে হবে?

ভদ্রমহিলা মনে হলো না এসব কিছু খেয়াল করছেন।

“আমি অনন্যা আজাদ।”

এমন ভাবে বললেন যেন নাম শুনেই চিনতে পারব। পেপার-টেপার আমার পড়া হয় না। খুব একটা টিভিও দেখি না। মুখশ্রী দেখে মনে হলো নায়িকা কিম্বা উপস্থাপিকা হবেন। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লাম, “অভিনয় করেন, তাই না?”

ভদ্রমহিলা ফিক করে হেসে দিলেন। বয়সঢাকা কাঁচভাঙা হাসি। অফিসের একমাত্র ড্রাফটস্‌ম্যান মিজান পর্যন্ত ঘুরে তাকাল। ভদ্রমহিলা ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে দিলেন।

কার্ড দেখে আমি একটু নার্ভাস বোধ করলাম। উনি আমার অস্বস্তি টের পেলেন। বললেন, “একটা ডিজাইন করতে হবে।”

“আমাকে?” বলেই বুঝলাম কথাটা বোকার মতো হয়ে গেছে। এটাই তো আমার পেশা।

“আপনি গুলশানে শুক্লাদের ইন্টেরিওর করেছেন।”

খুব বেশিদিন হয়নি শুক্লাদের কাজটা শেষ করেছি। কিছু অর্থাগমও ঘটেছে। তার উপর ভর করেই ইস্টার্ন প্লাজায় অফিসটা নিয়েছি। ভদ্রমহিলা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, “কাজটা ভালোও না, খারাপও না। ভিন্ন রকম। সে কারণেই কাজটা ভালো।”

একটা নামী কন্সট্রাকশন ফার্মের অন্যতম মালিক উনি এবং ওনার হাসবেন্ড। বিভ্রান্তি নিয়ে বললাম, “আপনাদের কন্সট্রাকশন ফার্মেই তো অনেক ইন-হাউজ আর্কিটেক্ট আছে।”

“আছে। বেশিরভাগ মিডল এজড্‌। করাপ্টেড অ্যান্ড কম্প্রোমাইজিড। আপনি ইয়াং। সেলফ এমপ্লয়েড। ভেতরে এখনও আগুন আছে। নিভে যাওয়ার আগেই সে আগুনের স্পর্শটা জরুরি।”

বুঝলাম না কার জন্য জরুরি। একটু থেমে আবার বললেন, “আমাদের বিবাহবার্ষিকী জানুয়ারিতে। ন মাসের ভেতরে বাড়িটা বানাতে হবে। আমার হাসবেন্ডের জন্য এটা একটা সারপ্রাইজ।”

বিবাহবার্ষিকীতে বরকে যিনি বাড়ি উপহার দেন তার সাথে কথা কম বলাই ভালো। চুপ করে থাকলাম।

“আমি আপনাকে ডিজাইন ব্রিফ ইমেইল করব। হ্যাভ এ লুক অ্যান্ড গেট ব্যাক টু মি।”

পরদিন ভোরে ইমেইল খুলে ডিজাইন ব্রিফ পড়লাম। সাইট লোকেশান টঙ্গি। তুরাগ নদীর ধারঘেঁষা জমি। দুই বিঘা। বাড়ি হবে তেতলা। বিল্ডিং ফুট প্রিন্ট পাঁচ কাঠা। বাকিটা ল্যান্ডস্কেপিং। নামও একটা রেখেছেন। স্ফটিক মহল।

প্রতিষ্ঠা নামক সুউচ্চ ভবনের সিঁড়ি ভেঙে সবে ওঠা শুরু করেছি। একটু উঠেই যেন একটা লিফট পেয়ে গেলাম। এমন সুযোগ হেলায় হারাবার প্রশ্নই ওঠে না। সঙ্গে সঙ্গেই আমার আগ্রহের কথা জানিয়ে দিলাম।

এর পর মাসখানেক গত হলো। কোনও খবর নেই। কাজটা নিশ্চই বড় কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনই হয়। আমিও দিবাস্বপ্ন ভুলে মধ্যবিত্ত জীবনের প্রাত্যহিক ঘানি টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

একজন উঠতি স্থপতিকে অনেক কিছুই করতে হয়। কখনও ফোটোগ্রাফি, কখনও গ্রাফিক ডিজাইন, কখনও বাড়ির মডেল বানানো, আবার কখনও থ্রি-ডি রেন্ডারিং। এরকম খুচরো অকাজগুলোই তাকে টিকিয়ে রাখে। সবচেয়ে কম করা হয় বাড়ির ডিজাইন।

এই মুহূর্তে হাতে কর্পোরেট ব্রান্ডিং-এর একটা কাজ। কালার স্কিম, ব্রোসিওর ডিজাইন, কার্ড ডিজাইন, লেটার হেড, এইসব। একটা ভারি ফটোশপ ফাইল পজিটিভ বানানোর জন্য ইপিএসে কনভার্ট করছি এমন সময় দরজায় টোকা। অনন্যা আজাদ। এবার আর ভেতরে ঢুকলেন না। দরজায় দাঁড়িয়েই বললেন, “সন্ধ্যা সাতটায় গুলশান চলে আসুন। অ্যাসপ্যারাগাস রেস্টুরেন্ট। হাতে সময় নিয়ে আসবেন।”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি চলে গেলেন।

সাতটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই রেস্টুরেন্টে হাজির হলাম। অনন্যা আজাদ জানালার পাশের একটি টেবিলে। আমাকে দেখে হাত নাড়লেন। এই প্রথম ওনাকে ভালো মতো লক্ষ্য করলাম। জিন্স আর ফ্লানেল শার্ট পালটে কলাপাতা রঙ জর্জেট শাড়ি পরেছেন। ওপরে ঘন সবুজ শাল। মদিগ্লিয়ানির আঁকা নারীদের মত লম্বাটে মুখ। মেকাপ দিলেও এত হালকা যে বোঝার উপায় নেই। মাথায় ঘন চুল এক বেণী করে পেছনে বাঁধা। খাবার অর্ডার করেই উনি সরাসরি কাজের কথায় এলেন।

“কাঁচবাড়ি সম্পর্কে ধারণা আছে?”

স্থাপত্যের ইতিহাস পড়েছি ছাত্রাবস্থায়। মিজ ভ্যান্ডার রহ’র ফার্নস্‌ওয়ারথ হাউজ, ফিলিপ জনসনের গ্লাস হাউজের কথা বললাম গড় গড় করে। হালের নরম্যান ফস্টারের কথা পাড়তেও ভুলিনি। নিজেকে আপ টু ডেট দেখাতে হবে তো।

“এর একশ বছর আগেই কিন্তু আরও বড় স্কেলের কাঁচবাড়ি হয়েছে।”

আমার মনে পড়ছিল না। উনিই ধরিয়ে দিলেন।

“ক্রিস্টাল প্যালেস। ১৮৫১ লন্ডনে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের দশ বছর আগে। ক্রিস্টাল প্যালেসের সাইট থেকে চার মাইল দূরেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথকে কবর দেওয়া হয়। ১৮৪৬-এ।”

স্ফটিক মহল নামকরণের রহস্য উদ্ঘাটিত হলো। এও বুঝলাম যে উনি যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই এসেছেন। আমি কিছু বলার আগেই অনন্যা বললেন, “শালিমার গার্ডেনের ডিজাইন দেখেছেন, লাহোরে?”

“দেখেছি। টেক্সট বুকে। মুঘল ল্যান্ডস্কেপিং। যোগ চিহ্নের মত পানির ধারা চারটি বাগানকে ধরে রেখেছে।”

“শালিমার গার্ডেনের মতো হবে ল্যান্ডস্কেপ । আর বাড়ির কথা তো আগেই বলেছি।”

ওয়েটার খাবার দিয়ে গেছে। আমার জন্য ফ্রায়েড রাইস আর মুরগির ভুনা। উনি প্লেটে সালাড নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। অনুরোধ করলাম বাড়ির ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করতে।

“একটা স্বচ্ছ স্ফটিক। প্ল্যানটা হবে অক্টাগনাল। ফর্মটা আপনি ঠিক করবেন। ভেতরে কাঁচের ফ্লোর, কাঁচের পার্টিশান। যতটা সম্ভব ওপেন প্ল্যান।”

কাঁচ নিয়ে ভদ্রমহিলার আসক্তি আমার মোটেও ভালো লাগছে না। জ্বালানির অপচয় আর কার্বন এমিশনের যন্ত্রণায় পরিবেশ অতিষ্ঠ। সময়টা এখন নবায়নযোগ্য উপাদান আর টেঁকসই স্থাপত্যের। কাঁচের মত জ্বালানিখোর পদার্থের চাকচিক্যের চমকে চিড় ধরছে ক্রমশ । কিন্তু কথাটা সরাসরি বলার সাহস পাচ্ছি না। কাজটা যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেয়? বললাম, “এত কাঁচ। ভেতরে কিন্ত খুব গরম হবে। প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকবে না।”

“ড্যান ব্রাউনের নতুন উপন্যাসটা পড়ছেন, ইনফারনো?”

“না।”

মনে মনে বললাম, “আপনার মত যখন তখন বিদেশি বই কিনে পড়ার পয়সা নাই ম্যা’ম।”

“পঞ্চম অধ্যায়ে একটা কাঁচের পার্টিশানের কথা আছে। বোতাম টিপে স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ করা যায়। সাস্পেন্ডেড পারটিক্যাল ডিভাইস। গুগল সার্চ করে দেখলাম জিনিসটা আছে। আপনি প্রাইভেসির কথা ভাবছেন। এই তো সলভ হয়ে গেল।” একটু থেমে বললেন, “করিম, কাজটা আমি আপনাকেই দিচ্ছি। দু-তিন মাস সময় নিন। শান্ত মনে রিসার্চ করুন। তারপর একটা প্রাথমিক ডিজাইন দাঁড় করিয়ে দেখান।”

ওনার মেঘমেদুর উদারতায় আমি দ্রবীভূত হলাম। মনে হলো পৃথিবী আজও কত সম্ভাবনাময়। সেদিন যাবার সময় একটা চেক রেখে গেলেন। অন্তত মাস ছয়েক অফিসের ওভারহেড নিয়ে ভাবতে হবে না। কিছুটা কৃতজ্ঞতা, কিছুটা আকর্ষণমিশ্রিত উত্তেজনা আর কিছুটা নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে আমিও উঠে পড়ে লাগলাম।

পরের দুমাসে অনেক কিছুই শেখা হলো। ডাবল গ্লেজিং, ট্রিপল গ্লেজিং, ট্রান্সপ্যারেন্ট ইন্সুলেশন, উইন্ড ক্যাচার, স্ট্যাক ভেন্টিলেশন। শালিমার গার্ডেনের প্ল্যান নিবিড়ভাবে নিরীক্ষা করলাম, পাথরের কাঠিন্যে ঘেরা সবুজ বাগানে কোমল জলের তারল্য কেমন আশ্চর্য হুল্লোড় বাধিয়ে দিতে পারে। মুঘল স্থাপত্য আর ল্যান্ডস্কেপিং-এর সাথে আমাদের সংসদ ভবনের মিল দেখে পুলকিত হলাম। ধীরে ধীরে অনন্যা আজাদ আর তাঁর প্রজেক্ট আমার মনের গভীরে ব্যক্তিগত হয়ে উঠল।

এর মাঝে উনি আরেকদিন ফোন করলেন। বেসমেন্টের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। স্ফটিক মহলে পাতাল ঘর থাকবে। একটা কাঁচের সিঁড়ির ঝর্নার মতো গড়িয়ে নেমে যাবে পাতাল ঘরে। পাতাল ঘরের ঠিক মাঝে প্যানিক রুম। প্যানিক রুম নামে নাকি একটা সিনেমা হয়েছে ২০০২ সালে। সেখান থেকে ধারণা নিতে বললেন।

প্যানিক রুম ব্যাপারটা আমার কাজে একটা গতি আর থ্রিল নিয়ে এলো। সিনেমাটা রোমাঞ্চ নিয়ে দেখলাম। পুরু লোহার দেয়ালে ঘেরা ব্যাংকের ভল্টের মত এই ঘর। নয়-এগারোর পর থেকে উত্তর অ্যামেরিকার দামি বাড়িগুলো প্যানিক রুমযোগেই বিক্রি হয়। হঠাৎ আক্রান্ত হলে ধনীদের বাঁচতে হবে যে! কাঁচের সিঁড়ি নিয়েও অনেক গবেষণা করলাম। একজন স্থপতির খোঁজ পেলাম। ইভা জিরিকনা। ভাস্কর্যের মতো অপার্থিব সুন্দর সব কাঁচের সিঁড়ি বানিয়েছেন। দেখলে মনে হয় জমাট বাঁধা সঙ্গীত। তেমন একটা সিঁড়ি আমিও ডিজাইন করলাম।

অনন্যার সৌজন্যে এর মধ্যে অফিসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বড় বড় কম্পিউটার মনিটর বসানো হয়েছে। পাইরেটেড অটোক্যাড সফটওয়ার পালটে লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। মডেল বানানোর হাত থেকে রেহাই দিয়েছে থ্রিডি প্রিন্টার। পরিবর্তন এসেছে আমার নিজের জীবনেও। সামিয়ার সাথে ক্রমশ গাঢ় হয়ে ওঠা সম্পর্কটা ভালো লাগাতেই থমকে থাকল। ওর ভাসা ভাসা জলতরঙ্গ জীবনে শোলার মতো ভেসে বেড়ানো হয়ত সম্ভব, কিন্তু নোঙর ফেলার মতো গভীরতা পেলাম না।

অনেক ইমেল বিনিময়ের পর জুলাই মাসের মাঝামাঝি ডিজাইন চূড়ান্ত হলো। প্রবল বর্ষায় তখন শহর ডুবে গেছে আর আকাশে পেপার ওয়েটের মতো ভারি ভারি পড়ন্ত মেঘ। এক শুক্রবার ভোরবেলা গায়ে এক রাশ বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে অনন্যা এলেন। আমরা সবাই অফিসের প্রিন্ট রুমে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে প্রিন্ট বোতাম স্পর্শ করলাম। সাদা ফ্রেমের উপর একটার পর একটা স্বচ্ছ আর অস্বচ্ছ প্লাস্টিকের আস্তর পড়তে লাগল। ধীরে ধীর স্ফটিক মহলের ত্রিমাত্রিক প্রিন্ট ভাস্কর্যের মতোই বিমূর্ত হলো। অনন্যা আমার ডান হাতে আলতো করে চাপ দিলেন। ওনার চোখে নতুন কন্টাক্ট লেন্সের মতো হালকা জলের চকচকে প্রলেপ।

অগাস্ট মাসে ভবন নির্মাণ শুরু হলো। থাইল্যান্ড থেকে স্পেশালিস্ট কন্সট্রাকশন টিম আনা হয়েছে। আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রতিদিন সাইটে বসে থাকি। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি নবীন বৃক্ষের মতো একটা ভবনের শেকড় গেড়ে বেড়ে ওঠা। মাঝে মধ্যে অনন্যা আসেন। হলুদ প্রটেকটিভ ক্যাপ পরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাইট ঘুরে দেখেন। সামান্য ভুল নজরে পড়লে ভেঙে নতুন করে গড়তে বলেন। মিস্ত্রিরা বিরক্ত হয়। আমি আপ্লুত হই।

এমন এক বিকেলে অনন্যা আমাকে ওনার বাসায় নিয়ে এলেন। আমাকে ড্রইং রুমে রেখে উপরে গেলেন। ডাবল হাইট রুম জুড়ে বেশ কিছু ভাস্কর্য আর পেন্টিং। আমি আগ্রহভরে দেওয়ালে ঝুলানো শিল্পী সুলতানের আঁকা বিশাল এক অয়েল পেন্টিং দেখছিলাম। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকালাম। কমলা শাড়ি পরা অপরূপা একটি মেয়ে সেগুন কাঠের রেলিং ধরে ব্যালেরিনার মতো নেমে আসছে। পেছন পেছন মধ্যবয়স্ক একজন লোক। মেয়েটির অন্য হাত লোকটির হাতে ধরা। লোকটা কিছু একটা বলছে আর মেয়েটি হেসে গলে পড়ছে। একসময় ওরা নিচের সোফায় এসে বসল। মেয়েটি এখন লোকটিকে জড়িয়ে ধরেছে। লোকটি মেয়েটির গালে বার বার চুমু খাচ্ছে। পুরো সময়টা ওরা আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। একটু পরেই বাইরে বেরিয়ে গেল। গাড়ির ইঞ্জিন চালুর শব্দ পেলাম। ইংরেজ আমলে মেমসাহেবরা ভারতীয় পুরুষ ভৃত্যকে দিয়ে কাপড় খুলিয়ে নতুন কাপড় পরতেন। পুরুষ ভৃত্য কী দেখল না দেখল তাতে কিছু যেত আসত না। কারণ ভৃত্যদের ওরা মানুষ বলেই গণ্য করত না। ভাবলাম আমাকেও হয়তো ওরা মানুষ বলে গণ্য করল না। আমার কান দুটো গরম হয়ে গেল। অনন্যা নিচে আসতেই বললাম, “এক ভদ্রলোক এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন।”

“আমার হাসবেন্ড।”

আমি জানতে চাওয়ার আগেই বললেন, “সাথের মেয়েটি ওর মিস্ট্রেস।”

তারপর বললেন, “চা না কফি, কী খাবেন?”

আমি কিছুই বলতে পারলাম না। মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল।

ডিসেম্বরের এক বিকেলে ভবনের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো কন্সট্রাকশন টিম। নির্ধারিত সময়ের সপ্তাহখানেক আগেই। অনন্যার চেয়েও বেশি আনন্দ আমার। যাক, ওদের সংসারটা এবার রক্ষা পাবে। রূপকথার মতো অত্যাশ্চর্য এক উপহার দিয়ে পরীর মতো সুন্দরী শাঁকচুন্নির হাত থেকে বরকে উদ্ধার করবেন অনন্যা। দাম্পত্য জীবনের আনন্দে আর ঔজ্জ্বল্যে উথালপাথাল করবে ওঁদের সংসার তরণী। আমার ভূমিকা তাহলে এখানেই শেষ। কেন যেন মনটা ভারি হয়ে এলো।

জানুয়ারীর এক তারিখ ওঁদের বিবাহবার্ষিকী। বিকেল চারটেয় ভবনের উদ্বোধন। প্রবল উত্তেজনায় এক ঘণ্টা আগেই উপস্থিত হলাম। নার্শিসাসের মতো অবাক বিস্ময়ে স্ফটিক ভবনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটু পর কালো মার্সিডিসে চড়ে অনন্যার স্বামী এলেন। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। বিরক্ত মুখে বাইরের বাগানে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। ভাবলাম, তবু ভালো, শাঁকচুন্নিটাকে সঙ্গে আনেননি। ঠিক চারটেয় আমার ফোনে টেক্সট মেসেজ এলো, ‘প্যানিক রুমে চলে এসো।’

অনন্যার প্রজ্ঞা আমাকে মোহিত করল। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা বোঝাপড়া হবে। সেটা যতটুকু পারা যায় প্রাইভেসিতেই হওয়া ভালো। অনন্যা চাচ্ছেন এ সময় আমিও ওনার পাশে থাকি।

আমি আর মিস্টার আজাদ ঝর্নার জলের মতো কাঁচের সিঁড়ি ভেঙে পাতাল ঘরে নামলাম। প্যানিক রুমের দরজা খোলা। ভেতরে বিয়ের শাড়ি আর গহনা পড়ে অপেক্ষমান অনন্যা আজাদ।

শায়িতা। প্রাণহীন।

আমি ফিরে গেলাম নিজের ডেরায়। দুদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে গুম হয় বসে রইলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম কী ঘটল। একসময় পুরো ব্যাপারটা আঁচ করে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।

এতদিন ধরে আসলে অনন্যার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করেছি। একটা তাজমহল বানিয়েছি। শালিমার গার্ডেনের ল্যান্ডস্কেপের কথা বলেছিলেন অনন্যা। সেটাতো তাজমহলেরও ল্যান্ডস্কেপ। স্ফটিক মহলের প্ল্যানটা অক্টাগনাল এবং সিমেট্রিক, তাজমহলেরও তাই। তাজমহলের পাতাল ঘরে মমতাজের সমাধি। অনন্যা শায়িতা আছেন স্ফটিক মহলের পাতাল ঘরের প্যানিক রুমে। শালিমার গার্ডেনের কাছেই শাহজাহানের শীস মহল, যার ইংরেজি ক্রিস্টাল প্যালেস। আর বাংলা? স্ফটিক মহল।

হে খোদা! আমাকে যেন অনন্যা আজাদের নাম বিশ্লেষণ করতে না হয়। আমি ভাবতে চাই না অনন্যা শব্দের আররি হলো মুমতাজ। আমি জানতে চাই না সম্রাট শাহজাহানের আরেক নাম আজাদ। আর আমি আব্দুল করিম, সেও কি তাজমহলের তিন স্থপতির একজন ছিল না?

এতদিন ধরে আভাসে ইঙ্গিতে অনন্যা তাজমহলের কথাই বলছিলেন। মৃত্যুর গহিনে তলিয়ে যাওয়ার সময় হয়ত একটা পিছু ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। চাইছিলেন যেন নিজ থেকেই বুঝতে পারি একটা সমাধির ডিজাইন করছি।

আর আমি বুড়বকের মত কিছুই ধরতে পারিনি? যা নিজের নয়, তা হারানোর শোকও যে কত তীব্র হতে পারে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম।

সেদিন রাতে নতুন কেনা মারুতি গাড়ি নিয়ে স্ফটিক মহলের কাছে গেলাম। অমাবস্যার রাত। ঘন অন্ধকারে স্ফটিক মহল হীরের টুকরোর মত জ্বলজ্বল করছে। ধীরে ধীরে ভেতরের বাতিগুলো রঙ বদলাচ্ছে। হলুদ থেকে ক্রমশ কমলা, কমলা থেকে ক্রমশ হলুদ। হঠাৎ মনে হলো স্ফটিক মহল যেন একটা জ্বলন্ত চিতা যার আগুনে অনন্যার অশান্ত আত্মা অনন্তকাল ধরে দাহ্যমান।

লিখেছেন এশরার লাতিফ

ফিচার ইমেজ লেখকের ‘স্ফটিক বাড়ি ও অন্যান্য গল্প‘ বইয়ের কভার ইমেজ।


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Leave A Reply

Your email address will not be published.