সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

যদি কলকাতা শহর তৈরিই না হত ?

What if the City of Joy, Kolkata was never born?

0 1,655

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love
না, কলকাতাকে নিয়ে নয়, আজকের গল্প আদি সপ্তগ্রাম আর সেখানকার পাঁচশো বছরের পুরণো টেরাকোটা মসজিদ নিয়ে।
আজকের হুগলি জেলার ক্ষুদ্র জনপদ আদি সপ্তগ্রাম কিন্তু বরাবর এই রকমই ছিল না। আদি সপ্তগ্রাম অতীতে কেমন ছিল তা জানতে আমাদের বেশ কয়েক শতক পিছনে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে বলি সপ্তগ্রাম নাম হওয়ার কারণ। কনৌজের রাজা প্রিয়বন্তের সাত ছেলে- অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুস্মান, জ্যোতিস্মান, দ্যূতিস্মান, সবন আর ভব্য একদিন তাদের রাজকীয় বিলাস ব্যসনে আসক্তি হারিয়ে বেড়িয়ে পড়লো শান্তির সন্ধানে। আজকের হুগলী জেলার অন্তর্গত ত্রিবেণীতে পৌঁছে তাদের মনে হলো এই জায়গাই তাদের সাধনার জন্য আদর্শ। সেই মতো সংলগ্ন সাতটি গ্রামে তারা তাদের আশ্রম তৈরি করলো। এই সাতটি গ্রাম হলো বাসুদেবপুর, বাঁশবেড়িয়া, নিত্যানন্দপুর, কৃষ্ণপুর, দেবানন্দপুর, শিবপুর এবং বলদঘাটি। এই গ্রামগুলো এখনো আছে। এই প্রসঙ্গে ত্রিবেণী সম্বন্ধে একটু বলে রাখি । এলাহাবাদের ত্রিবেণী আর পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী এই দুই জায়গাতেই গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতী এই তিনটি নদীর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে এলাহাবাদের ত্রিবেণী তে এই তিনটি নদী মিলিত হয়ে সঙ্গম তৈরী করেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী তে আবার এই একই তিনটি নদী এলো কোথা থেকে ? একটু বুঝিয়ে বলি। ঝাড়খণ্ডের রাজমহলের কাছে গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের কাছে দুভাগে ভাগ হয়ে এক ভাগ পদ্মা নামে বাংলাদেশের দিকে আর এক ভাগ ভাগীরথী নামে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণে বয়ে চলে। হুগলি জেলার ত্রিবেণীর কাছে এসে ভাগীরথীর মূল ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয় – একটি শাখা ভাগীরথী নামেই আর অন্য দুটির শাখার একটি সরস্বতী নামে দক্ষিণ পশ্চিমে এবং অন্যটি যমুনা নামে দক্ষিণ পূর্বে বইতে থাকে। সুতরাং একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে এই যমুনার সঙ্গে উত্তর ভারতের যমুনার কোনো সম্পর্ক নেই। এই কারণেই হুগলি জেলার ত্রিবেণী কে মুক্তবেণীও বলা হয়। আজকের নিশ্চিহ্নপ্রায় সরস্বতী নদী যখন পূর্ণযৌবনা তখন তার জলরাশি এবং নাব্যতা ছিল আজকের হুগলি নদীর থেকেও বেশি। ঐতিহাসিক নিহার রঞ্জন রায় বলেছেন এক সময়ে সরস্বতীই ছিল গঙ্গার মূল ধারা। আর তার তীরবর্তী সপ্তগ্রাম তখন ছিল এক অতি সমৃদ্ধ বন্দর নগর। এমনও মনে করা হয় যে সরস্বতী শুকিয়ে না গেলে হয়তো আজকের কলকাতার এই মহানগর হিসেবে গড়ে ওঠার প্রয়াজন পড়ত না।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সপ্তগ্রামের উল্লেখ থেকে এই বন্দরের খ্যাতির কথা জানা যায়। যেমন মনসামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী সপ্তগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্রের পথে যেত। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দরাম লিখেছেন, “সপ্তগ্রাম থেকে বণিকেরা কোথায় না যায়?”
History of Bengal, Bengal history, Adisaptagram, Adisaptahgram history, Adisaptagram port, Saptagram, Triveni, Triveni History, Jamaluddin Mosque, Jamaluddin mosque Adisaptagram, Kolkata, If Kolkata was never created, Sthapatya, Sthapatya.co, Sthapatya Publishers
১২৯৮ সালে দেবকোটের শাসক বাহরম ইৎগিন জাফর খান সপ্তগ্রাম জয় করেন।  ১৩৫০ সালে বাংলায় তুঘলক শাসনকালে (১৩৩৬–১৩৫৮) ইবন বতুতা সপ্তগ্রামে এসেছিলেন I তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, সপ্তগ্রামের স্থানীয় বণিকেরা বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন না। কিন্তু আরব, পারস্য ও তুরস্ক থেকে বণিকেরা এখানে বাণিজ্য করতে আসতেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পর্তুগিজ বণিকেরা সপ্তগ্রামে আসা যাওয়া করতে শুরু করেন। পর্যটকদের বিবরণ থেকে সপ্তগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। ভেনিসীয় পর্যটক সিজার ফ্রেডেরিক ১৫৬৩ থেকে ১৫৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রাচ্য ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণবিবরণী থেকে ভারত ও বাংলার অনেক শহর ও বন্দরের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, সপ্তগ্রাম বন্দরে ৩০-৩৫টি জাহাজে মাল তোলা হত। এর থেকেই তার ব্যাপ্তির একটা অনুমান করা যায়। আবার যেমন ইংরেজ পর্যটক-বণিক রালফ ফিচ বলেছেন, “উত্তর আফ্রিকার শহরগুলির তুলনায় সপ্তগ্রাম রূপকথার নগরী।” শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যই নয় আরো একটা কারণে সপ্তগ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। মহম্মদ বিন তুঘলকের মুদ্রা নীতি আমরা সকলেই কম বেশি জানি। তুঘলকের সময়ে প্রচলিত স্বর্ণ মুদ্রার নাম ছিল দিনার আর রৌপ্য মুদ্রার নাম ছিল আদিল। রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তরের পরে বাংলার সপ্তগ্রামে তুঘলক রৌপ্য মুদ্রার টাঁকশাল তৈরী করান। কারণটাও সহজেই অনুমান করা যায়। সেই সময়ে দেশে রুপোর যোগানের ঘাটতি দেখা দিলে বিদেশ থেকে রূপো আমদানি করে মুদ্রা তৈরির প্রয়োজন পড়ে। সেই কারণেই বন্দরের কাছে টাঁকশাল তৈরি হয়। পরবর্তী কালে অবশ্য মূলত যোগানের ঘাটতির কারণেই সোনা আর রুপোর মুদ্রার পরিবর্তে তামা আর দস্তার মুদ্রার প্রচলন করেন। নকল মুদ্রায় গোটা দেশ ভরে গেলে আবার সোনা রূপোর ব্যবহার শুরু হয়।
কিন্তু চিরদিন তো আর সমান যায় না। কালের প্রভাবে একসময়ে পলি জমে সরস্বতী নদীর নাব্যতা কমতে শুরু করে। তখন আদিগঙ্গার পথ ধরেই সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল করতে থাকে। আসতে আসতে বণিকেরাও অন্যত্র সরতে শুরু করেন। শেঠ ও বসাকেরা চলে আসেন গোবিন্দপুর গ্রামে। অনেক পরে সুতানুটিতে আসেন জোব চার্নক। সপ্তগ্রাম বন্দরের সম্পূর্ণ পতন হলে উত্থান ঘটে কলকাতা মহানগরীর।
History of Bengal, Bengal history, Adisaptagram, Adisaptahgram history, Adisaptagram port, Saptagram, Triveni, Triveni History, Jamaluddin Mosque, Jamaluddin mosque Adisaptagram, Kolkata, If Kolkata was never created, Sthapatya, Sthapatya.co, Sthapatya Publishers
যাক সে কথা.. যা নেই সেকথা বাদ দিয়ে এবার আসি যা এখনো আছে সেই কথায়। আদি সপ্তগ্রামে এখনও রয়েছে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরণো একটা টেরাকোটা মসজিদ। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যবিদ হেনরিক ব্লকম্যান এই মসজিদে আসেন। তার লেখা থেকেই জানা যায় সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ছেলে সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের রাজত্বকালে কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী আমোল শহর নিবাসী সৈয়দ ফকরুদ্দিন আমুলী-র ছেলে জনৈক বিদ্বান সৈয়দ জামালুদ্দিন ৯৩৬ হিজরীতে (১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে) এই মসজিদ তৈরি করেন। এনাদের সম্পর্কে যদিও আর বেশি কিছু জানা যায় না তবে নির্মাণ শৈলীর বিচারে এই মসজিদের গুরুত্ব অনেক। বাংলা ইঁটের তৈরি এই মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে তিনটি প্রবেশ দ্বার। পশ্চিম দিক অর্থাৎ কিবলার দিকের দেওয়ালে রয়েছে অনবদ্য টেরাকোটা কারুকার্যমন্ডিত তিনটি মিহরাব। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন, ইসলাম মতে, মক্কার দিকটি হলো কিবলা দিক এবং সেই দিকে মুখ করেই প্রার্থনা করার নিয়ম। তাই বাংলা তথা ভারতের সব মসজিদের ক্ষেত্রেই মসজিদের পশ্চিম দিকের দেওয়ালটিই কিবলার দিকের দেওয়াল। সেই দেয়ালেই কিছুটা ভিতরের দিকে ঢোকানো অংশই হলো মিহরাব। ইমাম সাহেব মিহরাবের ভিতরে বসে আজান পাঠ করবেন যাতে তা পুরো মসজিদ প্রাঙ্গনে প্রতিধ্বনিত হয়। আগেকার দিনে তো আর মাইক ছিল না তাই এই ব্যবস্থা। এক সময়ে মসজিদের চার কোনায় চারটে মিনার ছিল কিন্তু এখন একটা ছাড়া বাকি গুলো আর অবশিষ্ট নেই যেমন আজ আর নেই মসজিদের ছাঁদ, কবেই তা ধসে গেছে। মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব দিকে রয়েছে তিনটি সমাধি যেগুলো সৈয়দ ফকরুদ্দিন, তার বেগম এবং তাদের খোজার বলে মনে করা হয়। মসজিদের প্রবেশ দ্বারে রয়েছে পাথরে খোদাই করা নির্মাণ ফলক এছাড়াও বেশ কিছু ফলক রয়েছে মসজিদ চত্বরে যেগুলো অন্য কোথাও থেকে এনে রাখা হয়েছে বলেই মনে হয়। সেগুলোতে অন্য দুটো মসজিদের কথা বলা আছে। একটিতে ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে তরবিয়ত খানের দ্বারা নির্মীয়মান কোনো মসজিদের কথা বলা আছে আর অন্যটিতে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফতেহ সাহেবের সময়ে তৈরি হওয়া অন্য একটি মসজিদের কথা। কিন্তু এই দুটি মসজিদ ঠিক কোথায় ছিল বা আদৌ আজ আর সেগুলো আছে কিনা জানা যায় না।
History of Bengal, Bengal history, Adisaptagram, Adisaptahgram history, Adisaptagram port, Saptagram, Triveni, Triveni History, Jamaluddin Mosque, Jamaluddin mosque Adisaptagram, Kolkata, If Kolkata was never created, Sthapatya, Sthapatya.co, Sthapatya Publishers
শেষ করার আগে বলি, বাংলায় টেরাকোটা মন্দির বেশ কিছু আছে বটে কিন্তু টেরাকোটা মসজিদের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। কিছু আবার ঝড়, ভূমিকম্পে চিরতরে হারিয়ে গেছে। যেকটা আছে সেগুলোর অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। যদিও এই মসজিদটি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (ASI) রক্ষণাধীন তবুও এই সব গুলোই কিন্তু শিল্পগুণ এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিরীখে জাতীয় সম্পদ। তাই শুধু সরকারেরই নয়, বরং ধৰ্ম, সম্প্রদায় নিবিশেষে এগুলোকে বুক দিয়ে আগলে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আর একটাকেও হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

লিখেছেন অভিজিৎ দাস।

ফিচার ইমেজ ও অন্যান্য লেখকের থেকে।


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Leave A Reply

Your email address will not be published.