সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন

গড় জঙ্গলের গুপ্তধন- ইছাই ঘোষের দেউল

Treasures of Garh Jungle- Destruction of the Ichai Ghosh Deul

1 2,435

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

Spread the love

গুপ্তধন’ শব্দটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। আজকের লেখা এই গুপ্তধন সন্ধানের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই লেখা। গল্প নয় , বরং সত্যি ঘটনা!

আজ থেকে প্রায় বছর ত্রিশেক আগের কথা। অজয়ের গা ছুঁয়ে কনকনে উত্তুরে হাওয়া ভেসে আসছে কেন্দুলির দিক থেকে। নদীটা পেরোলেই বীরভূম , এপারে বর্ধমান। মাঝখানে সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে বয়ে চলছে অজয়ের এই ধারাপ্রবাহ! শীতকালে অবশ্য জল থাকেনা  তেমন। চাঁদের আলোয় শুকনো বালির চরগুলো চিকচিক করে জ্বলছে। নদীর ধার ঘেঁষে শাল , শিরিষ আর অর্জুনের ঘন জঙ্গল। জনবসতি তেমন একটা নেই বললেই চলে। পুব দিকে মাইলটাক গেলে অযোধ্যা , বনকাটির মত কিছু প্রাচীন গ্রাম চোখে পরে।

সন্ধ্যে নামলেই জঙ্গল থেকে ভেসে আসে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক। আরেকটু রাত বাড়লে, দূরে গাছের মাথা থেকে রাতজাগা পাখি ডেকে ওঠে তীক্ষ্ণ স্বরে। রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যেও দু চারটে জোনাকি উড়ে বেড়ায়!

বর্ধমানের দিকটায় কিছুটা জায়গায় জঙ্গল সাফ করা আছে নদীর ধারে। সেই ফাঁকা জায়গাটার নৈঋত কোণে এক অদ্ভুত দর্শন বিশালাকার দেউল দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েক শতাব্দী ধরে! রাতের অন্ধকারে বড়ই অদ্ভুত লাগছে দেখতে। সামনের ফাঁকা চাতালটায় আগুন জ্বালিয়ে জনা তিনেক লোক চাদরমুড়ি দিয়ে বসে আছে গোল হয়ে! আগুনটার জন্য আশে পাশে কিছুটা জায়গা আলোকিত হয়েছে! সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে যে একপাশে কয়েকটা গাইতি, কোদাল আর শাবল জড় করে রাখা। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। কারণ রাতের বেলা তো দূর, দিনের বেলাতেই জঙ্গল ভেদ করে এদিকে তেমন একটা কেউ আসেনা!

এদিকে প্রবল ডাকাতের উৎপাত। দুপুরবেলা ঠাকুরমশাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়েচলা পথ বেয়ে এদিকটায় একবার আসেন  পুজো করতে। মিনিট দশেকের মধ্যেই কাজ সমাধা করে ফেরার পথ ধরেন তাড়াতাড়ি! তবে এত রাতে এরা কারা?

ইদানিং অবশ্য মাসখানেক ধরে এক সাধুবাবা আস্তানা গেঁড়েছেন এখানে! জানুয়ারি মাসে জয়দেবের মেলার ঠিক আগে থেকেই সাধুরা এ অঞ্চলে ভিড় জমাতে থাকে ! নদীর ওপারে ঠাই না হলে , কেউ কেউ এপারে এসেও তাবু খাটিয়ে থাকেন ! কিন্ত জয়দেবের মেলার তো এখনো মাস খানেক বাকি ! তবে?

মাঝে মাঝে দমকা উত্তুরে হাওয়ায় আগুনটা নিভে আসছে! একজন লম্বা লোক উঠে পাশের শুকনো ডালের স্তুপ থেকে কয়েকটা ডাল নিয়ে আগুনে ফেলে দিল!

– বস, বারোটার পর কাজে লেগে পরব! ঘণ্টা তিনেক লাগবে ভাঙতে। মাল খালাশ করে ভোরের আগে ইলামবাজার পৌঁছাতে হবে–  লম্বা লোকটা বলল।

– মইটা মন্দিরের পিছনের জঙ্গলে রাখা আছে। নিয়ে আয়। অনেকক্ষণ লাগবে ভাঙতে! খেয়ে উঠেই লেগে পর– মাঝ বয়সী দাঁড়িওয়ালা একজন লোক উত্তর দিল। ভদ্রলোকের পড়নে গৈরিক উত্তরীয়, আচমকা দেখলে সাধু সন্ন্যাসী বলে ভ্রম হয়।

– আমার তো মনে হচ্ছে আগে শালা এই মূর্তি গুলো ভেঙে ফেলি। এই যে চারদিকে বড় বড় মূর্তি বানিয়ে রেখেছে! এগুলোর পিছনেই আছে!

– নাহ! ওগুলো ইট কেটে কেটে বানিয়েছে। পিছনটা ভরাট আছে! আমি চেম্বারটা থেকে টর্চ মেরে দেখেছি। এমনি এমনি এখানে পরে আছি নাকি দিনরাত! থাকলে উপরের দিকটায় আছে! মন্দিরটার একদম উপরে দেখবি কলসির মত একটা জিনিস আছে। ওটার ভেতরেই থাকবে মালটা!

ওহ! বলে প্রথম লোকটা পাশের ঘটটা থেকে জল নিয়ে কুলকুচি করে ফেলল ঘাসের উপর।

তৃতীয় জন নিঃশব্দে উঠে টর্চ টা মারল মন্দিরের গায়ে। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে মেরেকেটে কুড়ি পঁচিশ ফুট হবে মন্দিরটা, কিন্ত উচ্চতায় উঠে গেছে অন্তত ষাট ফুটের কাছাকাছি। অনেকটা যেন আমাদের হাতের মধ্যমার মত লম্বাটে! স্থানীয় লোক বলে ইছাই ঘোষের দেউল।

আশেপাশের গ্রামের বৃদ্ধরা বলেন হাজার বছর আগে রাঢ় বাংলার স্বাধীন সামন্ত রাজ ইছাই ঘোষ তার আরাধ্য দেবী ভগবতীর আরাধনা স্থল হিসেবে এই স্থাপত্যের নির্মাণ করেন। প্রাচীন ধর্মমঙ্গল কাব্যে ইছাই ঘোষের উল্লেখ আছে। কয়েকফিটের সরু গলি বেয়ে মূল গর্ভগৃহে প্রবেশ করলে দেখা যায় আদতে গর্ভগৃহ শূন্য! কোন মূর্তি নেই! উপরের দিকে তাকালে দেখা যায় ইটের তৈরি এক প্রাচীন গম্বুজ। টর্চ না মারলে দিনের বেলাতেও দেখা যায়না এত উঁচু!

তৃতীয়জন এই অঞ্চলেরই লোক। ছোটবেলা থেকেই সে দুটো জনশ্রুতি শুনে আসছে এই অঞ্চলকে ঘিরে। কেউ কেউ বলে কর্ণ সেনকে হারানোর পর সামন্তরাজ ইছাই ঘোষ তার অর্জিত বিপুল ধনরাশির একটা অংশ এনে এই জঙ্গলেরই কোথাও লুকিয়ে রাখেন। ইছাই ঘোষের মৃত্যুর পরও বহু বছর ধরে এই এলাকা পরিচিত ছিল গোপভূমি নামে। জঙ্গল মহলের একটা বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে গোপরাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল একসময়। সম্ভবত তারই পূর্ব সীমান্তে, এই অঞ্চলে এক দুর্গ নির্মাণ করেছিল কোন প্রাচীন রাজা! সেই থেকেই এই জঙ্গলের নাম গড়জঙ্গল, ঢেঁকুরগড় বা শ্যামারুপার গড়!

ছেলে বেলায় খেলতে খেলতে জঙ্গলের পায়ে চলা কাঁচা রাস্তা থেকে দিকভুল করে সে বেশ কয়েকবার পশ্চিম দিকটায় চলে গিয়েছিল। সেখানে দেখেছিল একটা দশ পনেরো ফুট উঁচু মাটির ঢিপি একটা প্রকাণ্ড জায়গাকে গোল করে ঘিরে রেখেছে! ঠিক যেন একটা বিশালাকার মাটির বাটি রাখা আছে জঙ্গলের মাঝে! বাটির মাঝখানে অনেক গুলো ছোট ছোট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ!

ঢিপির গায়ের মাটি খুঁড়লে লালচে ইট বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। উত্তর দিকে কয়েকটা ভাঙ্গা সিঁড়ি আছে! তবে সবথেকে অদ্ভুত জিনিসটা হল গোল জায়গাটার বাইরে, একটা বড় বেদী আছে জঙ্গলের মধ্যে। মুঘল আমলের বা পাল সেন যুগের ছোট ছোট পোড়া মাটির ইট দিয়ে তৈরি নয় বরং রীতিমত বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি বেদী! মার্কণ্ডেয় পুরান বলে– অন্তত দেড়-দু হাজার বছর আগে রাজ্যহারা রাজা সুরথ, মেধস মুনির পরামর্শে এই গহন জঙ্গলের মধ্যেই প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা করেন বাংলার বুকে! এই কিংবদন্তীর সত্যাসত্য বিচার করা কঠিন এত যুগ পরে, তবে একথা সত্যি যে গোটা জায়গাটার পরতে পরতে ইতিহাস জড়িয়ে আছে!

এই অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে অনেকেই মোহর পেয়েছে! মোহর পেয়ে রাতারাতি কোটিপতি হবার গল্প এখনো লোকমুখে ফেরে!

দ্বিতীয় জনশ্রুতিটা প্রচলিত আছে ভবানী পাঠক’কে ঘিরে। পাশের জঙ্গলেই এক উঁচু টিলার উপর আছে শ্যামারুপার মন্দির। টিলার একধারে আগাছা সরালে এখনো বহু প্রাচীন এক ঘাট দেখা যায়। এখন সেই ঘাট গিয়ে মিশেছে চাষের জমিতে কিন্ত লোকগাথা অনুযায়ী বহুযুগ আগে ঐ ঘাট গিয়ে পরত অজয়ের বুকে। তখন অজয়ের গতিপথ ছিল অনেকটাই দক্ষিণে! ঐ ঘাটের শেষে এক সুরঙ্গ ছিল। কেউ কেউ বলে সেই সুরঙ্গ চলে গেছে একদম সেই দুর্গাপুরের সিটি সেন্টার অব্দি। ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভবানী পাঠকের ডাকাতদল ব্যবহার করত এই পথ! ছোটবেলায় গ্রামের পুরুতমশাই একটা আগাছার জঙ্গল দেখিয়ে বলেছিলেন যে আগে এখানেই ছিল সেই সুরঙ্গপথ, যেটা পরবর্তী কালে ব্রিটিশরা এসে সিল করে দেয়। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস সেই ডাকাতদলের অর্জিত বিপুল ধনসম্পত্তি আজও লোকানো আছে এই জঙ্গলেরই কোথাও!

– মালটা ছুঁড়ুন! তাড়াতাড়ি!

লম্বা লোকটার ডাকে তৃতীয় জনের ঘোরটা ভেঙে গেল!

লম্বা লোকটা সার্কাসে কাজ করে! মিনিট দশেকের মধ্যে আশ্চর্য দক্ষতায় সে মন্দিরটার গা বেয়ে উঠে গেছে কীর্তিমুখটার কাছে!

গেরুয়া পরা লোকটা একটা নাইলনের দড়ির মত কিছু একটা ছুঁড়ে দিল উপর দিকে! লম্বা লোকটা সেটা কোমরে না বেঁধে পিঠের ব্যাগে পুরে আবার গিরগিটির মত উঠতে থাকল! অনেক পুরনো মন্দির, ইট গুলো আলগা হয়ে রয়েছে। উপরের দিকে বাজ পরে ফাটল ধরেছে কয়েক জায়গায়! সেখানে ছোট ছোট গাছ গজিয়েছে! লোকটা সেই গাছ গুলোকে ধরেই উঠছে সাবধানে!

কয়েকজায়গায় ইট খসে খসে গর্ত হয়ে গেছে! সেরকম একটা গর্তে টর্চ মারতেই দুটো তিনটে টিয়া তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল কানের পাশ দিয়ে! লোকটা এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য তৈরি ছিল না! কিছুটা হতচকিত হয়ে একটা ইটের খাঁজকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল! বাঁ হাত থেকে চার সেলের টর্চটা আলগা হয়ে সোজা পঞ্চাশ ফিট নীচে একটা পাথরের উপর পরে সশব্দে চুরমার হয়ে গেল!

বুকের ভেতরে ধড়াস ধড়াস করে আওয়াজ হচ্ছে তৃতীয় জনের! উপরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার! হালকা কুয়াশার চাদরে মন্দিরের উপরটা ভালো বোঝা যাচ্ছেনা! লম্বা লোকটারও কোন রকম নাড়া চড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা নীচে থেকে। টর্চের ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে গিয়ে গেরুয়া পরা লোকটা টর্চ মারল।

নাহ! লোকটার সাহস আছে! সেই চাঁদের ক্ষীণ আলোর আর কুয়াশার মধ্যেই দেখা গেল একটা লম্বা শরীর হাচর পাচর করে উপরের দিকে উঠছে অন্ধকারের মধ্যে! আর মাত্র কয়েক ফিট! মন্দিরটার একদম উপরে একটা ছোট্ট চাতাল আছে। পাঁচ ফিট বাই পাঁচ ফিটের! লোকটা সেখানে উঠে পিঠে থেকে কিছু একটা বার করে নীচের দিকে ছুঁড়ে দিল। একটা দড়ির সিঁড়ি নীচে অব্দি এসে মাটি ছুঁল!

দাঁড়িওয়ালা লোকটার আর তর সইছেনা! সে নীচে থেকে শাবল আর কুর্নির মত একটা জিনিস ব্যাগে ভরে দড়িতে পা রাখল।

  • ওটায় ছেনি হাতুড়ি আছে। নিয়ে চলে আসুন।

তৃতীয় জনও শেষ ব্যাগটা পিঠে নিয়ে উঠতে শুরু করল! নাইলনের শক্ত দড়ি , ছেঁড়ার ভয় নেই! কিন্ত সন্ধ্যে থেকে শিশিরে ভিজে ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে রয়েছে! অর্ধেক ওঠার পর অজয়ের দিক থেকে একটা দমকা হাওয়া ভেসে এল!

উফ! কি ঠাণ্ডা! মোটা জ্যাকেটের আস্তরন পেরিয়ে হাওয়াটা যেন শরীর ছুঁল! হাত দুটো আর কানের নীচটা বরফ ঠাণ্ডা হাওয়ায় শিথিল হয়ে আসছে! উপরে দাঁড়িআলা লোকটা উঠছে দ্রুত! তার পায়ের চাপে ঝুর ঝুর করে নরম ইটের গুঁড়ো আর শ্যাওলা জাতীয় কিছু নীচের জনের গায়ে এসে পরছে ক্রমাগত! ফিট চল্লিশেক ওঠার পরেই চারিপাশটা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল! এখন আর নীচেটা ভালো দেখা যাচ্ছেনা! চাঁদের হালকা আলো কুয়াশার সাথে মিশে এক অদ্ভুত আলো আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে! মন্দির গাত্রের অদ্ভুত দর্শন নরসিংহের মত ভাস্কর্যটাকে যেন আরো ভয়ঙ্কর লাগছে এই পরিবেশে!

উত্তুরে হাওয়ার চোটে তৃতীয় জনের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পরছে ঠাণ্ডায়! উফ! কেন যে মরতে আজ এলাম! সে মনে মনে ভাবছিল! কিন্ত লোভ যে বড় বিষম বস্তু!

শেষ পর্যন্ত মিনিট পনেরোর চেষ্টায় দুজন উপরে উঠে এল! খুব ছোট্ট জায়গা! তিনজন একসাথে দাঁড়ানো মুশকিল! দ্বিতীয় জন ইতিমধ্যে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে! চূড়ার আমলক অংশটা আকারে বেশ বড়! তার উপর পাথরের তৈরি ছোট্ট কলস! শাবল দিয়ে আঘাত করলে ঢং করে গম্ভীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে!

-নাহ! এতে নেই! এ মালটা সলিড! ভেঙে ফেল।

লম্বা লোকটা শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে ছোট্ট কলসটাকে উপড়ে ফেলে দিল! ফুটবল সাইজের পাথরের জিনিসটা ষাট ফুট উপর থেকে নীচে শক্ত মাটির উপর আছড়ে পরল!

শক্ত কাঁকুড়ে মাটির সাথে আঘাতটা এত জোরে হল যে ঢং করে তার প্রতিধ্বনি অজয়ের ওপার থেকে শোনা যেতে লাগল! শব্দটার প্রাবল্য যেন দ্বিতীয় লোকটার হৃদয়ে গিয়ে ঘা মারল! তার ভেতরে ভেতরে প্রবল অনুশোচনা হচ্ছে আজকের এই হঠকারি কাজের জন্য! ভয়, অনুতাপ, উত্তেজনা আর অনুশোচনার এক অদ্ভুত মিশ্রনে সে স্থির হয়ে আছে!

-ভাঙ! নীচেটা দেখ!

আপনি হাত লাগান! ইটের জয়েন্টে মারুন বস। চুন সুরকির গাঁথনি আছে, কোনা করে মারলে খুলে আসবে!– এই প্রবল ঠাণ্ডাতেও দুজন ঘেমে গেল! জুলফি আর কানের মধ্যে দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম নেমে আসছে! জ্যাকেটের ভেতর পিঠটা ঘামে ভিজে জব জব করছে দুজনেরই! খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে কারণ হাজার বছরের পুরনো স্থাপত্যে শাবল দিয়ে বা গাইতি দিয়ে জোরে ঘা মারলেই গোটা দেউলটা থর থর করে কেঁপে উঠছে!

আমলকটা ভাঙ্গা প্রায় শেষ হয়ে এল!

– বস, এতে কিচ্ছু নেই!

– আরো নীচেটা ভাঙ। ভেতর থেকে একটা ছোট গম্বুজ দেখা যায়! সেটার উচ্চতা বেশ কম। মাঝখানে একটা ফাঁপা অংশ থাকার কথা এই চাতালের নীচে।  ফাটিয়ে দেখ।

দুজন ক্রমাগত হাত চালাচ্ছে! এত খাটনি হবে তারা ভাবেনি! তৃতীয় লোকটা চাতালের এক ধারটায় বসে বসে ঠাণ্ডায় কাঁপছে থর থর করে! সে হাত লাগায়নি একটুও!

গেরুয়া পরা লোকটা বসে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে একটা নোংরা গালাগালি দিল! তুই বলেছিলি পাক্কা খবর! মাল আছে! না পেলে তোকে এই গর্তে ভরে প্লাস্টার করে দেব শালা! – বলে আবার ছেনি হাতুড়ি তুলে নিল হাতে!

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! চাঁদনী রাতে শালের জঙ্গল ছাড়িয়ে ইছাই ঘোষের দেউল দেখা যায় বহু দূর থেকে! জ্যোস্নাপ্লাবিত চরাচর আর ফিকে কুয়াশার চাদরে মোড়া নিস্তব্ধ রাতে, দেউলের চূড়ায় তিনটে ঝাপসা কায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার! অনিয়মিত ছন্দে ছেনি হাতুড়ির ঠং ঠং শব্দ উত্তুরে হাওয়ায় ভর করে গোটা গড় জঙ্গল সহ অজয়ের অববাহিকায় ছড়িয়ে পরছে দূরদুরান্তে! নীচে, নিভে আসা আগুনটার কিছু স্ফুলিঙ্গ ও ধোঁয়া একসাথে মিশে আকাশের দিকে কালো একখানা সাপের মত পাক খেয়ে খেয়ে উঠে আসছে উপরে! পুব দিকে আলো ফোটার সময় হয়ে এল প্রায়।

——————————————————————————————————————————————————————

সূর্য মাথার উপর ঊঠে গেছে বহুক্ষণ আগে! শীতের সকালে এই মিঠে রোদ গায়ে মাখতে ভালোই লাগে! জঙ্গলের লাল কাঁকুড়ে মেঠো পথ দিয়ে ঠাকুরমশাই আসছেন প্রশান্ত চিত্তে! নদীর ধারে ফাঁকা জায়গাটায় এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন!

একি! দেউলের চূড়াটা কেউ যেন সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে গেছে। গোটা চাতালটা জুড়ে পুরনো ভাঙ্গা ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাথরের কলসটা দু টুকরো হয়ে পরে রয়েছে ত্রিশ চল্লিশ ফিট দূরে। অনতিদূরে কিছু পোড়া কাঠ আর ছাই মিশে রয়েছে ঘাসের সাথে!

এরপর?

এরপর আর কি! এ এস আইয়ের কাছে খবর গেল! তারা এসে নতুন করে বানালেন মন্দিরের চূড়োটা! সমস্ত কিছু সারাই করা হল। নীল রঙের বোর্ড বসল। চারিধারে পাঁচিল উঠল।

গুপ্তধন সত্যিই ছিল কি ছিলনা সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই ! এ এস আইয়ের রিপোর্টেও এই নিয়ে কোন উল্লেখ নেই ! যতদূর জানি, যারা এই কাজের সাথে যুক্ত ছিল তাদেরও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি শেষ পর্যন্ত!

আজকাল গড় জঙ্গলে যাওয়া অনেক সহজ হয়েছে , রাস্তা ঘাট ভালো হয়েছে। ডাকাতির খবরও বিশেষ শোনা যায়না! কেউ যদি আজকাল গড় জঙ্গলের রাস্তা ধরে ইছাই ঘোষের দেউল দেখতে যান, খেয়াল করে দেখবেন দেউলের উপরের অংশটায় যে গম্বুজটা নতুন করে তৈরি করেছে এ এস আই, তার ইটের রঙ এবং দেউলের নীচের অংশের ইটের রঙ সম্পূর্ণ আলাদা! কারণ উপরের একটা বড় অংশই নতুন করে নির্মাণ করতে হয়েছিল ১৯৯০ সালের এই ঘটনার পর!

* সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা! কাহিনী নির্মাণের প্রয়োজনে কিছু অংশের কল্পনা করা হয়েছে।
** ইছাই ঘোষের দেউলের নির্মাণ কাল নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে! পরে সময় পেলে এই নিয়ে আলাদা করে লিখব!
*** যারা ইছাই ঘোষের দেউল, গড় জঙ্গল এবং শ্যামারুপার মন্দিরে যেতে চান তাদের জন্য নীচে গুগল ম্যাপ রইল। ইদানিং শীতকালের দিকে অনেকেই এই অঞ্চলে যান পিকনিকের জন্য! দেউলের ধারেই দেউল পার্ক ইকো রিসোর্ট আছে। থাকা খাওয়ার কোন সমস্যা হবেনা!  এছাড়াও গোটা অঞ্চলটাই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শনে পরিপূর্ণ! গেলে অবশ্যই নিকটবর্তী বনকাটি  গ্রামের টেরাকোটা মন্দির, জয়দেবের মন্দির এবং তেপান্তর নাট্যগ্রাম  (সাতকাহানিয়া) ঘুরে আসবেন।

লিখেছেন অরুনাভ সান্যাল, কো- ফাউন্ডার ও এডিটর, স্থাপত্য

ফিচার ইমেজ সোর্স


স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক  (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

  1. Souvik Bhattacharya says

    ইছাই ঘোষ বা ইশ্বর ঘোষের যে তাম্রশাসন পাওয়া গেছে তা।অনুযায়ী একাদশ শতকে উনি গোপভূমের ঢেক্করীতে রাজত্ব করতেন এবং সেই সময় সম্ভবত বর্তমান মনে মেদিনীপুর এর কোন অংশের রাজা কর্ণসেন এবং তাঁর পুত্র লাউসেনের সাথে তার যুদ্ধ।হয়।এই যুদ্ধ।অনেক পরবর্তী কালে ধর্মমঙ্গল কাব্যের রূপ পেয়েছে।ওঁর দেউল টি যদিও ঐতিহাসিক রা অনুমান করেছেন আরও অনেক পরবর্তী কালে ওঁর কোন বংশধর তৈরি করেছে।যদিও একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি একইরকম কিছু দেউল পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় দেখা যায় যেমন সুন্দরবনের জটার দেউল, বাঁকুড়ার বাহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর দেউল কিংবা বরাকরের দেউল।শ্যামারূপার গড় এবং তার সংলগ্ন মন্দির এবং একটি মন্দিরের ধ্বংস স্তুপ।খুবই রহস্যময় লেগেছিলো।

    প্রাসঙ্গিক তথ্যের জন্য রেফার করব
    পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি -বিনয় ঘোষ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

error: Please get in touch at info.sthapatya@gmail.com