স্থাপত্য পাবলিশার্স
বর্ধমান । কোন্নগর । কোলকাতা
Sthapatya Publishers
Burdwan | Konnagar | Kolkata
info.sthapatya@gmail.com
Shubhayan M: +918653792921
Arunava S: +9194323 43169
স্থাপত্য পাবলিশার্স
বর্ধমান । কোন্নগর । কোলকাতা
Sthapatya Publishers
Burdwan | Konnagar | Kolkata
info.sthapatya@gmail.com
Shubhayan M: +918653792921
Arunava S: +9194323 43169
Trending
Get real time updates directly on you device, subscribe now.
ছোটো থেকে বর্ধমানে বড় হয়েছি। তখন লেট নাইনটিজ। থাকতাম শাঁখারী পুকুর এলাকায়। কখনো বাবার হাত ধরে , কখনো ঠাম্মার সাথে গুটি গুটি পায়ে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে থেকে স্কুল বাস ধরতাম। সেভাবে পড়াশুনোর চাপ শুরু হয়নি তখনও , থ্রি ফোরে পড়তাম হবে। ফাঁক পেলেই ছাদে যাওয়া ছিলো স্বভাব। মায়ের চেঁচানি কম শুনিনি। বাবা অফিস থেকে এলে নালিশ হত আমার নামে, ‘দ্যাখো তোমার ছেলে কিন্তু না বলে দৌড়াতে দৌড়াতে ছাদে উঠে যায় , কিছু হলে কিন্তু আমাকে দোষ দেবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাবা আর আর কিই বা বলবেন, তিনি নিজেই আশির দশকে সি.এম.এস এর পোশাকে বৃষ্টি কাদা এক করেছেন। ডানপিটে এক দল ছেলের দলকে নিয়ে সাধনপুর হাউজিং কাঁপিয়েছেন। তাই তার ছোট্ট ছেলে যদি এই কঠিন শহরের বুকে একফালি আকাশ খুঁজতে সবেধন নীলমণি ওই ছাদের দিকে পা বাড়ায় , তাহলে তার বেশ আনন্দই হয় মনে মনে। ছেলে তো আর তার মত ছেলেবেলা পায়নি , নাহয় সাধের মধ্যে থাকা ওই আকাশটুকুই পাক। মুখফুটে যদিও এই কথাগুলো তিনি কোনদিন কাউকে বলেন নি, কিন্ত আমি বুঝতে পারতাম, কারণ বাবারও ছাদের প্রতি প্রবল একটা টান ছিল।
তিনতলার সেই ফ্ল্যাটের ছাদ ছিল সেকালের চারিপাশের সবথেকে উঁচু স্পট, ছাদে উঠলে চারিপাশটা বেশ অনেক দূর অব্দি দেখা যেত। খুব যে দৃষ্টিনন্দন ভিউ ছিল, তা বলা যায় না, কিন্তু খারাপ লাগতো না। সবথেকে মজা হতো যখন উৎসব প্রাঙ্গণে কোনো মেলা বসত। মেলা বসার এক সপ্তাহ আগে থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে দেখতাম বাঁশের ধাঁচা, তার ওপরে রংবেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হত মেলা প্রাঙ্গণ। তবে সবথেকে আনন্দ পেতাম যেদিন ওরা নাগরদোলাটা বানাতো। ছেলেবেলার ইনোসেন্স, কিছুই বুঝতাম না কোথা থেকে কিভাবে কি জুড়ে অত বড় একটা গোলমত লোহার দানবটা বানিয়ে দিত। তাতে আবার দিব্বি চড়াও যায়! যাইহোক, রাতের অন্ধকারে মেলা উঠতো জ্বলে, হাজার আলোর সমাগম, মানুষের কোলাহল, মাইকের অ্যানাউন্সমেন্ট ও ঘুরতে থাকা নাগরদোলার মধ্যে দিয়ে সেই কটা দিন বাকার ধারের অন্ধকার মাঠটাও আলোর রোশনাইতে জ্বলজ্বল করত। আমি ছাদ থেকে দেখতাম। আরেকবার, আমরা, মানে আমি আর বাবা কালি পুজোর সময় দু প্যাকেট কালিপটকা কিনে এনেছিলাম। আমাদের বাজি পোড়ানোর জায়গা ছিল সেই ছাদ। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা করে করে কালিপটকা ফাটানোর পর সেবার বাবা রীতিমত ধৈর্য্যচুত হয়ে দ্বিতীয় বান্ডিলটা একসাথে ধরিয়ে দিল। আমি নেহাত ছোট তখন। প্রবল ওই দুম দাম শব্দের মধ্যে আমি রীতিমত ভয় পেয়ে এক ছুটে গিয়ে সোজা বাবার কোলে! পাশের ফ্ল্যাটে থাকতো এক দাদা, বেশ বয়েসে বেশ বড় ছিল আমার থেকে। সে ছিল আমার খেলার সঙ্গী। নাম জিজ্ঞেসা করে লজ্জা দেবেন না কারণ মগজ বলে আশ্চর্য ড্রাইভটার কোনো এক ধুলো মাখা গ্রে সেলে নামটা সযত্নে ঘুমোচ্ছে, সে আর ডিফ্রাগমেন্ট করে লাভ নেই। আমাদের খেলার জায়গা ছিল সেই ছাদ। খেলার মাঠ বাড়ির কাছেই ছিল বটে, কিন্তু সমবয়সী বন্ধু ছিলনা সেরকম। আর বাকি ছেলেপুলে গুলোকে ঠিক পছন্দ ছিলনা , কেন জানিনা।
আগে বেশ সুন্দর কংক্রিটের শান দেওয়া ছাদ ছিল, সকালের দিকে গেলে কুয়াশা ভেজা ছাদে খালি পায়ে চললে বেশ ঠাণ্ডা লাগতো পায়ে। তখনো অব্দি ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর’ দরকার পড়েনি, তাই পায়ের তলার চামড়া ছিল বেশ নরম। বেশ ভালো লাগতো। হালকা শ্যাওলা মলিন ভিজে ছাদে একবার দৌড়াতে গিয়ে দুম্পটাশ হওয়ায় কোথাও একটা লেগেছিল। নিচে এসে বলায় মাতৃসম আদর তো দুর, কষে কান মোলা খেয়েছিলাম। ভারতীয় মায়েরা আদতে বেশ অন্য প্রজাতির জীব হয় জানেন তো, আর অধিকাংশ বাবারা হয় বেশ মিচকে রসিক প্রকৃতির।
‘কান মলে দিয়েছে? তো জানতে যখন, আরেকটু দৌড়ে নিলেই পারতে!’ আহা, কি উচ্চ বিচার।
যাকগে। ইতিমধ্যে বর্ষাকালে ঘরে ড্যাম্প ধরা শুরু করেছে, নীল রঙের চুনরং দেওয়ালের ওপরে সাদা নুনের আস্তরণ পড়েছে। আর্কিটেকচার পড়তে এসে জানলাম সেই নোনা ধরাকে বলে এফার্ভেসেন্স। মজার নাম বেশ। সবাই বললো ছাদ থেকে জল নামছে, ওয়াটারপ্রুফ ছাদ চাই। গর্মেন্টের তৈরি ফ্ল্যাট, সেখানে আবার ওইসব! সব শেষে একদিন দেখলাম কিছু রাগী দেখতে লোক বড় কালো বুট ও ইয়া বড়ো গ্লাভস পরে এসে ছাদে মোটা আস্তরণের পিচ চট লাগিয়ে দিয়ে গেল। আরে আচ্ছা বজ্জাত, শনি রবিবার ছাড়া সময় পেলি না? দুদিন ছাদে ওঠা বারণ ছিল সেসময় ! ধূসর শেওলা সবুজ ছাদ আমার হয়ে গেলো কুচকুচে কালো। ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাতে থেকে হল বিটকেলে রকমের গরম। ছাদের সাথে খালিপায়ের সম্পর্কের সেখানেই ইতি।
কিন্তু এ কি অনাসৃষ্টি? কোন উজবুকের বাবার কথায় ওরা ছোট্ট নুড়ি পাথর ছড়িয়ে গেছে পিচের ছাদের ওপরে? এ তো দেখি হাঁটাই যাচ্ছেনা। দৌড়াতে গিয়ে শেষে পড়ে গিয়ে হল সিরিয়াস ইঞ্জুরি।
এইবার অবশ্য আর বকা নয়, মা ওষুধ লাগিয়ে আদর করেছিল সেবার। কিন্তু ঐদিকে তো ছাদে কিছু করা যাচ্ছেনা। শুধু আমি না, কমপ্লেইন করল অনেকেই। হাটতে গেলে পায়ে লাগে, চপ্পল পরেও নিস্তার নেই। নাহ, এ তো হতে দেওয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হবে। বাবার বর্ষাকালের মোটা প্লাস্টিকের চটি নিয়ে একদিন উঠলাম ছাদে, কোনমতে হলহলে ফিটিংসের সেই চপ্পল দিয়েই শুরু ঘষা। লেগেছিল বেশ কয়েকদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম । পুরোটা একেবারে পরিষ্কারও হয়নি তাতে। কিন্তু বেশিরভাগ পাথরগুলোকে ঢিলা করে পিচ থেকে ছাড়িয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। ঝাঁট দিয়ে এক কোণে সরিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ফেলে দেব, কিন্তু তখনো অতটা সাহস হয়নি। এত খাটনির ফল অবশ্য বেশিদিন উপভোগ করতে পারিনি । ঠাম্মা রিটায়ার করার পরে আমার সেই শৈশবের স্মৃতিমাখা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে আসতে হয় পুলিশ লাইনের ঐদিকে সুকান্তনগর নামে এক শান্ত শিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট পাড়ার এক কেনা বাড়িতে।
অতদিনের সেই ভালোবাসার সম্পর্ক হঠাৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সেদিন। হঠাৎ ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের শেষে কেই বা আর তার প্রাক্তনের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় ? সেই ছাদে আজ অব্দি আর যাওয়া হয়নি আমার।
তারপরে বহুদিন সেই সুকান্তনগরের একতলা বাড়িতেই থেকেছি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বিই কলেজে ভর্তি হবার পরেও। একতলা সেই বাড়ির ছাদের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো হলেও মনের টান বিশাল কিছু ছিলনা। ছাদে উঠে কিছুই দেখা যেত না প্রায় । আশেপাশের বাড়ির ছাদে শুকোতে দেওয়া জামা কাপড় ছাড়া। হাউজিং এর তিনতলার ছাদে আকাশের সাথে খেলে বড়ো হওয়া ছেলের কি আর একতলা ছাদ মানায়? তবু, সবথেকে মজা পেতাম যখন ছাদে জল দেওয়া হতো। গরমকালে বাবা বিকেলের বা সন্ধ্যার দিকে ছাদ ঠাণ্ডা করতে জল ঢালতেন ছাদে । নিচু ছাদ হলেও, জল দিয়ে ছপাং ছপাং করার মজাই আলাদা।
কলেজে উঠে হোস্টেল এগারোর ছাদটা বেশ পছন্দের ছিল। স্লেটার হল দেখা যেত, নিম ঝিল, ডাউনিং ইত্যাদি সেই ব্রিটিশ আমলের লাল লাল স্থাপত্য গুলো সব দেখা যেত। বিদ্যাসাগর সেতু ও দেখতে পেতাম সেখান থেকে।
সিনিওর হবার পর ঠিকানা হল রিচার্ডসন হল। এককথায় আমাদের হগওয়ার্টস ছিল ওটা। সেখানে ছাদ ছিলনা বটে, কিন্তু যা ছিল, তা ছাদকে হার মানায়। তার নাম ক্যানোপি। কোটি গল্পের সাক্ষী সেই ক্যানোপী, উঁচু না, একতলা মাত্র। বেশি বড়ও না, কিন্তু অত্যন্ত আপন, অত্যন্ত প্রিয়। সন্ধেবেলা গিয়ে বন্ধুরা মিলে সটান শুয়ে পড়তাম সেখানে। ওপরে নীল আকাশের মধ্যে পেঁজা তুলোর মত মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি। মাঝে মাঝে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়াগুলো উঠে মিলিয়ে যেত সেই মেঘের মধ্যে, অথবা বেশিরভাগ সময় কুচকুচে নীল কালো রাতের আকাশে। আমরা তখন উড়ে বেড়াচ্ছি সাহারা আটলান্টিসের উপরে, খেলে বেড়াচ্ছি পিঙ্ক ফ্লয়েডের তালে তালে। ক্যানোপির দুপাশে দুটো খেজুর গাছ, মধ্যেখানে চঞ্চলদা সহ আমি ও বেশ আরো কিছু উৎসুক ছেলেপিলের বানানো একটা দেওয়াল চিত্র। তার ওপরে রিচার্ডসন আর সব শেষে অন্তহীন আকাশ। রিখটার্সদের যে অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল সেই ক্যানপি, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ক্যানোপির বাকি গল্পঃ নাহয় পরে একদিন করব। এখনও ছাদের গল্প যে শেষ হয়নি ।
ফাইনাল ইয়ারে ইন্টার্নশিপের সময়ে দার্জিলিঙে ছিলাম। ছোট্ট অফিস, শুধু বস আর আমি। ব্যাস। যেটুকু অনসাইটে শেখা, আমার বস এর থেকেই। নাম দিপাং লামা। হেব্বি কড়া ধাতের মানুষ। আমার মত ডানপিটে ছেলেকেও সিধা করে দিয়েছিল। আস্তানা ছিল হোটেল রাফখাং। সেখানেই একটা ঘরে অফিস আর আরেকটি ঘরে থাকতাম আমি। ইন্টার্নশিপ এর সময় দশ হাজার টাকা ও থাকা-খাওয়া দিয়েছিলেন। মনটা বড্ড ভালো ছিল যদিও একটু রগচটা। তো, সেই হোটেলের ছাদে উঠলে দেখা যেত অসাধারণ এক দৃশ্য। দুদিকে সবুজ চোখজোড়ানো পাহাড় আর মাঝের ভ্যালিতে দার্জিলিং শহরটার ছোট ছোট ছবির মত বাড়িগুলো যেন কেউ নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছে। রাত্রিবেলা মনে হত যেন আকাশের তারাগুলো নেমে এসেছে নিচে। প্রত্যেকদিন রাত্রিবেলা এক ঘন্টা বরাদ্দ ছিল সেই ছাদে। কালের নিয়মে মাস ছয়েক বাদে সেই ছাদকেও বিদায় জানাতে হল।
বাড়ি ফিরে দেখি দোতলা তৈরি। তিনতলার চিলেকোঠার ঘর ও রেডি। তার উপরে আবার একটা ছাদ ও বানানো হয়েছে। আমাদের পাড়া ও বেশ কিছুদূর অব্দি আমাদের এই ছাদই সবথেকে উঁচু। আরিব্বাস। এ তো দারুন খবর। আমার আনন্দ আর দেখে কে! এক ছুটে চলে গেলাম ছাদ। গিয়ে যেন মন ভরে গেল প্রথমদিনই। সত্যি বলছি, বহুদিন পরে আবার সেদিন যেন আকাশের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম আমি। হাত বাড়াতে হয়নি, আকাশ যেন নিজেই এসে বুকে টেনে নিয়েছিল আমায়।
তার পরে, এই ছাদ দেখেছে আমার যৌবনের কত মুহূর্ত। আনন্দে আত্মহারা হয়েছি কখনো, কখনো আবার রাগ দুঃখে স্থবির হয়ে বসে থেকেছি। আমার লাল চোখের দৃষ্টি বিভ্রম থেকে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে নিবিড় ভাবনা চিন্তা। বলতে গেলে, ছাদের ওপরে ছাদ। চিলেকোঠার ওপরের সেই ছোট্ট এক ফালি মুক্ত মঞ্ছে পৌঁছাতে গেলে মূল ছাদ থেকে দুটো লোহার কালো আলকাতরা মাখানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। কুড়ি বাই আটের ঐ ছাদে আবার বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে সাড়ে সাতশো লিটারের কালো প্যাটন ট্যাংক। বাকি জায়গাটুকুর উপরে এই ভণ্ড গণতন্ত্রের যুগে আমার রাজতন্ত্র। এখানে আমি স্বাধীন। যেমন ছিল দই। মনে পড়ে দই কে? দত্ত ভার্সাস দত্তর সেই ডায়ালগ, ‘দই ওয়াজ স্বাধীন। দই ওয়াজ ফ্রী। হাউ আই ওয়ান্তেড টু বি লাইক দই।’ ছোট্ট এই এক ফালি ছাদে , প্রতিদিন এই পরাধীনতার রাজত্বে আজও আমি মুক্ত।
যৌবনের অ্যাড্রেনালিন পেড়িয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হবার সাক্ষী এই কুড়ি বাই আটের ছাদ। নিজের চিন্তাধারার বদল হতে দেখেছি নিজেই। ‘ডু ওর ডাই’ থেকে ‘যা হবে দেখা যাবে’ তে পালটাতে দেখেছে এই ছাদ। সেই ‘যা হবে দেখা যাবে’ এর ভরসায় না থেকে নিজের হাল নিজে ধরার পরিবর্তনটাও হয়ত এই ছাদই দিয়েছে। অথবা হয়তো হয়েছে নিজেই, ছাদটা জাস্ট ক্যাটালিস্ট। আকাশের বড্ড কাছে নিয়ে গেছে আমাকে। দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, দিয়েছে সাহস। নিজেরটা নিজে করে নেওয়ার তাগিদ, এবং লড়াই করে যাওয়ার মনভাব। আর দিয়েছে স্বাধীনতা। স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন বোনার আর পূরণ করার।
আমাদের ছাদ থেকে বর্ধমান শহরের সবথেকে উঁচু বাড়িটা দেখা যায়। টাওয়ার বলবো না, কারন টাওয়ার নয় সেটা। নয়-দশ তলা উঁচু সদ্য গড়ে ওঠা এই শহরের বুকে একদল মানুষের স্বপ্নের আস্তানা। চলতি রিয়েল এস্টেট বিজনেসের লেটেস্ট ভেঞ্চার। মার্কেটিং গিমিক বাদ দিলে আপস্কেল ফ্ল্যাটবাড়ি, পয়সাওয়ালা বাবুদের স্ট্যাটাস স্যিম্বল। সেই ফ্ল্যাটবাড়ির নিচ দিয়ে যেতে যেতে আমার আজও মনে হয়, ‘ওপরের ওই ব্যাল্কনিওলা ফ্লাটটা থেকে না জানি কত সুন্দর ভিউ হবে, এই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদটা না জানি কত উঁচু।’ না, এইখানে নিজের বাড়ি কেনার কথা কখনো ভাবিনি । অত মুরদ নেই আসলে।
কিন্তু ছাদের লোভ কি অত সহজে ছাড়া যায় রে পাগলা ?
মধ্যেখানে যখন দিল্লিতে থাকতাম, তখন আস্তানা ছিল নয়ডার কাছে তিনতলা এক ফ্ল্যাটবাড়ি। ওয়ান বেডরুম সেট, ব্যাচেলর মানুষের জন্যে অনেক। কাজের জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিল আস্তানা। বাঁচিয়ে দিত দিল্লির মেট্রো। যেতে দেড় ঘণ্টা, ফিরতেও তাই। উপরি পাওনা মেট্রো থেকে নামার পরে হাড়জ্বালানো ট্রাফিক জ্যাম। রোজকার খরচা দেড়শো টাকার ওপরে।
বলতেই পারেন, কি দরকার কর্মস্থল থেকে এত দূরে থাকার?
দরকার হয়ত নেই, কিন্তু, দাদা, সেই ওয়ান বেডরুম সেট এর সাথেই যে অসাধারণ এক ব্যালকনি রয়েছে, আর রয়েছে কয়েকটি সিঁড়ি ভাঙলেই বিশাল বড় ছাদ? সেখান থেকে দেখা যেত সামনের ফাঁড়িটা, যাতায়াতের পুল। ফোরগ্রউন্ডে কিছু দূরে কংক্রিটের ব্রিজের ওপরে দিল্লি মেট্রোর ম্যাজেন্টা লাইন, মিডগ্রউন্ডে কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল শেড যেখানে প্রতি রাতে ক্লান্ত মেট্রোর রেকগুলো নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকত। এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে সমগ্র নয়ডা শহরের প্রথম সারির স্কাইস্ক্র্যাপার। ছিল ফাঁড়ির ওপারে মেট্রো স্টেশন যাবার রাস্তা, কোন দিন ভাগ্যক্রমে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে সন্ধেবেলায় ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে বেশ ট্রাফিকে আটকানো যান বাহনের আলো দেখতে দেখতে চা খেতাম। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে স্বচ্ছ দেখা যেত নয়ডার আলো, বোঝা যেত ঐ স্কাইস্ক্র্যাপার এর ব্যাস্ত জীবনযাপন। শীতের সকালে কুয়াশার সাদা চাদরে অবশ্য লুকিয়ে যেত সবাই , শুধু দূরে বিশাল বাঁকের মধ্যে দিয়ে দেখা যেত চলমান মেট্রোগুলোকে।
সেই সবের মাঝেই, স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকত এক আকাশচুম্বী স্থাপত্যশৈলী। নাম সুপারনোভা। ৯৮৪ ফুট উঁচু, আশি তলা মিক্সড ইউজ কমপ্লেক্স। দেখা যেত বহু দূর থেকে! বাড়ির ছাদটা থেকে অসাধারণ ভিউ পাওয়া যেত। রাতেরবেলা আলো জ্বলে থাকলে প্রত্যেকটা ফ্লোরকে আলাদা আলাদা করে স্পষ্ট বোঝা যেত। সেই কটা দিন, এই সুপারনোভা ছিল আমার স্বপ্নের মূলধন! না জানি আশি তলার উপর থেকে কতদুর দেখা যায় ? হয়ত গোটা শহরটাই। দিল্লির শীতের ভোরবেলায় না জানি ঐ উপর থেকে না জানি কত সুন্দর লাগবে এই কুয়াশাচ্ছন্ন শহরকে। এই ঘোরা ফেরা করত আমার মাথার মধ্যে। কিন্তু, কোনদিন সেই সুপারনোভার ছাদে ওঠার চেষ্টা করিনি। ভয় ছিল, একবার দেখে নিলেই হয়ত স্বপ্নগুলো আর আসবে না। হয়তো আশিতলার প্রেমে এই তিনতলার ছাদের মায়া কেটে যাবে।
এবং ঠিক শাঁখারিপুকুরের সেই ছোটবেলার ছাদের মতই একদিন হঠাৎ এই বড়বেলার ভালোলাগার ছাদ এবং স্বপ্নগুলোকে পিছনে ফেলে রেখে চলে আসতে হয় বাসায় ফেরত, বর্ধমানের সেই কুড়ি বাই আটের ছাদে। পিছনে পড়ে থাকে সুপারনোভা, ভারতের সবথেকে উঁচু বিল্ডিং।
উচ্চতার সাথে প্রেম আমার বহুদিনের। ছোটবেলার সেই আর ৬০ এর ছাদ থেকে আজকে। কখনো উঠেছি, কখনো নেমেছি। বিভিন্ন ছাদের সাথে জড়িয়ে আছে কত স্মৃতি, কত গল্প। হউসিং এর ছাদে মিশে আছে ছেলেবেলার ইনোসেন্স, বিই কলেজের ক্যানোপিতে বাঁধানো আছে কত অমূল্য স্মৃতি। দিল্লির ছাদ সাক্ষী আছে বন্ধুর সাথে সারারাত গল্পের, সাক্ষী আছে ভালোবাসার, অভিমানের। আর আজকের সুকান্তনগরের এই ছাদের সাথে জড়িয়ে আছে বড় হয়ে ওঠা , কৈশোর আর যৌবনের কত আবেগ ।
আসলে হয়তো উপরে ওঠার এই শখ সহজে পূরণ হবার নয়। দোতলা খুঁজবে দশতলা, এবং তারপরে তারও উপরে যাবার আকাঙ্খা জাঁকিয়ে বসবে ভেতরে, দুর্বিষহ করে দেবে বেঁচে থাকাটা। আসলে উপরে ওঠার আকঙ্খাটা আমাদের আদিম প্রবৃত্তির একটা। মানুষ যেমন প্রভাবে , প্রতিপত্তিতে, যশে, খ্যাতিতে জীবনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চেয়েছে ঠিক তেমনই আবার একদল মানুষ চেয়েছে পাখির মত ডানা মেলে উপরে উড়তে। একটা ঈগলের চোখ দিয়ে দেখতে চেয়েছে নিজের চেনা পৃথিবীটাকে। আমার ছিল দ্বিতীয়টার শখ। কিন্তু, উপায় নেই বলতে বলতেই উপায় খুঁজে পেলাম সে পথের ঠিকানা।
প্রযুক্তির ডানায় ভর করে আজ আমি সত্যিই মুক্ত। আজ আমার উচ্চতার শখ পূর্ণ হয়েছে। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে আমি আজ নিজের চেনা শহরটাকে অনেক অনেক উপর থেকে খুঁজে ফিরি। বাকিটা নাহয় আবার পরে একদিন বলব । আজ শুধু এইটুকু বলতে চাই, যে আকাশ আসেনি আমার কাছে। আজ, আমি নিজে পৌঁছে গিয়েছি আকাশের ভেতরে, পৌঁছে গেছি সেই উচ্চতায় যেখানে মেঘেরা খেলে বেড়ায়। সেখান থেকে, পৃথিবী সুন্দর, পৃথিবী কোমল।
অনেক বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে, আজ, আমি শঙ্খচিল।
লিখেছেন শুভায়ন এম, কো- ফাউন্ডার ও এডিটর, স্থাপত্য।
ফিচার ইমেজ সহ সব ছবি লেখকের।
স্থাপত্য সাধারন মানুষের মধ্যে আর্কিটেকচার ও ডিজাইন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় একমাত্র অনলাইন ম্যাগাজিন। আমাদের পাশে থেকে ও সমর্থন করে এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমাদের সাহায্য করুন।
ওয়েবসাইট (Website) | ফেসবুক (Facebook) | ইন্সটাগ্রাম (Instagram) | লিঙ্কড-ইন (LinkedIn)
Get real time updates directly on you device, subscribe now.
Shubhayan M is a graduate architect from the Dept. of Architecture, Town & Regional Planning, IIEST Shibpur. Currently a student of Rural Management at the Institute of Rural Management, Anand, and a freelance design journalist, he is passionate about visiting places and exploring the local rituals, cultures, traditions, and people. He is the co-founder and managing editor of Sthapatya, the only platform in the world that discusses design and architecture in Bengali with the aim of raising design awareness amongst the common populace by using a colloquial language of expression. He won the third position in the International Essay Competition 2020 organized by the Council Of Architecture, India in August, 2020. He was also awarded the A3F Architectural Journalism Award '17 by the A3F Foundation in Chandigarh in November 2017 for his constant efforts to promote the field of design literature in India. He has been awarded the Writing Architecture Trophy ’17 in the 61st NASA Convention in Jaipur. In the past, he has served as the convener and editor-in-chief of the Indian Arch '16, the annual journal of National Association of Students of Architecture, India, and has been the student editor of the Indian Institute of Architects West Bengal chapter.
Prev Post
Next Post
Recover your password.
A password will be e-mailed to you.
A friend of mine, Samir Rakshit, ex professor of Architecture at Jadabpore university, l was told the co founder of Sthapatya. Am l right or have l mistakenly named the magazine. It was supposed to be the first bengali literature magazine on Architecture. Anyway l enjoyed reading your story. When is the next one coming..
Hello sir.
As per our knowledge, Sthapatya.co is the first online portal that discusses architecture & design in Bengali. The first magazine about architecture that was published in Bengali was ‘Nirmaan’, however, we are unable to furnish you any further details owing to lack of it in the first place. There are multiple companies named Sthapatya, however, Sthapatya.co happens to be the first online portal in Bengali. There have been a few newer ones who have started after getting inspired by us, a few of which happens to be located at Bangladesh.